চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক ইসহাক কাজল

SHARE

মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইসহাক কাজল আর নেই। গতকাল সোমবার লন্ডন সময় বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে গ্রেটার লন্ডনের কুইন্স হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। তিনি ৭২ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনী, আত্মীয়-স্বজন এবং রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের সহকর্মীসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।

২০০০ সাল থেকে পরিবার নিয়ে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ইসহাক কাজল দীর্ঘদিন ধরে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়ছিলেন। চার বছরেরও বেশি সময় ক্যান্সারে ভুগে চলে গেলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগন্জ উপজেলার পতনউষা ইউনিয়নের পতনঊষা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পতনউষা বালক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, নয়াবাজার কৃষ্ণচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও সিলেট মদনমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনায় ছাত্রলীগের সদস্য থাকাকালীন ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানসহ বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে অংশ নেন ইসহাক কাজল। ১৯৭১ সালে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শত্রুর খোঁজে রণাঙ্গনে বিরামহীন সাড়ে নয় মাস অতিবাহিত করেন। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ইসহাক কাজল উপলব্দি করেন, স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আসেনি। এ উপলব্দি তাকে আবারো মাটি ও মানুষের কাছে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

৭৫ এর ১৫ই আগস্ট জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পুলিশী হয়রানীর শিকার হয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকতে হয় ইসহাক কাজলকে। পরিণামে শিক্ষকতার চাকরিটিও হারাতে হয়।

পরবর্তীতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন ইসহাক কাজল। ১৯৭৬ সালে সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এক মাস ৭ দিন কারাবরণ করেন তিনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণেও একাধিক মামলার সম্মুখীন হয়ে দেশত্যাগ করে চার বছর কুয়েতে কাটাতে হয় তাকে। এরপর ২০০০ সালের ২১ এপ্রিল যুক্তরাজ্যে চলে আসেন ইসহাক কাজল।

এই প্রবীন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক একজন লেখক ও সাংবাদিক হিসেবেও সুপরিচিত। বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত এ লেখকের লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২১টি। সিলেট প্রেস ক্লাব ও লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব নির্বাহী কমিটিতেও বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৮৫-৮৬ সালে সিলেট প্রেস ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও পরবর্তীতে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবে তিন মেয়াদে নির্বাচিত তথ্য ও গবেষণা এবং এক মেয়াদে প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক জনমতের পলিটিক্যাল এডিটর এবং যুক্তরাজ্য ওয়াকার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন ইসহাক কাজল। পাশাপাশি যুক্তরাজ্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সম্মানিত সভাপতি হিসেবেও ছিলেন অধিষ্ঠিত।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ইসহাক কাজল সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি, জেলা সংবাদপত্র হকার ইউনিয়ন ও সমবায় সমিতির সভাপতি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সিলেট জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সিমিটার-বিরোধী আন্দোলন, মধুবন-বিরোধী আন্দোলন, সিলেট বিভাগ আন্দোলন, মাগুরছড়া গ্যাস বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের আন্দোলনসহ জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।