আমার জীবনই আমার বাণী। ফানি লাগল? আচ্ছা, তাইলে বলি, আমার বডি ল্যাঙ্গোয়েজই আমার উপদেশ। আবার এ রকমটাও বলা যায়, একটা মোমেন্টেও কারও উপদেশকে মিনিমাম পাত্তা দিয়ো না, এটাই আমার ম্যানিফেস্টো। নিজের ফাঁটে চলো, নিজের মাঠে খেলো। দ্যাখো ভাই, ক্রিকেটার অনেক এসেছে-গেছে। গাওস্কর তেন্ডুলকরের মতো ভগবান এসেছে, চুনোপুঁটির তো লেখাজোখা নেই। আমার নামে যখন ইতিহাসে চ্যাপটার হবে, ব্যাটিং-এর জন্যেও হবে না, উইকেটকিপিং-এর জন্যেও নয়। আমার মূর্তি গড়া হবে, অ্যাটিটুডের জন্য। অবশ্য না গড়া হলেও থোড়াই কেয়ার।
ছোট শহর থেকে এসে কেল্লা ফতে করেছি, তাই তাদের অনুপ্রেরণা; প্রথম চান্সেই ক্যাপ্টেন হয়ে লাগ ভেলকি লাগ দেখিয়েছি, তাই ভাগ্যের আপন ভাইপো; অসম্ভব ধনী হয়েছি, তাই আমার পদবি সার্থক; এ সব বড় কথা নয়। বড় কথা হল, যেখানে তোরা সব্বাই ‘লোকে কী বলবে’ সামনে ঝুলিয়ে প্রত্যেকটা মুহূর্ত নিজের প্রেম থেকে পায়খানা পুরোটা রেগুলেট করছিস, সেখানে আমি কোনও দিন ‘আমি কী ভাবব’ ছাড়া কিস্যুকে পাত্তা দিইনি। দিই না। রিপোর্টারগুলোকে না, টিভির কেষ্টদের না, কর্কশ নিন্দুককে না, পাগল ফ্যানদের না, এমনকী আমার নিজের টিমের প্লেয়ারদের ফোন অবধি আমি আদ্ধেক সময় ধরি না। ক্রিকেট খেলছি, পপুলারিটি কনটেস্টে তো নামিনি। আমি কি এখনকার আঁতেল, সারা দিন দেঁতো ফোন করে করে সেলেব হব?
হাড্ডাহাড্ডি ওয়ান-ডে সিরিজ শুরুর আগে, তিন সিনিয়র মহারথীকে বাদ দিতে বলেছি, লোকে আমার গর্দান এই নেয় কি সেই নেয়। আমি বলেছি, হবে না ভাই, এরা ফিল্ডিং জানে না, এদের নেব না। তার পর সিরিজ জিতেছি। যদি হারতাম? আমার মুন্ডু নিয়ে গেন্ডুয়া খেলা হত। পোস্টারে জুতো ঝুুলত। ক্যাপ্টেন্সি চিরকালের মতো বাজেয়াপ্ত হত। সেই ভয়ে মত বদলাব? ধুস! সেফ খেলার চেয়ে না-খেলা ভাল। আমি বাঁচি আমার শর্তে। বাকি পৃথিবী সরু গর্তে।
ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে উইনিং স্ট্রোকটা ছয় মারলাম। তার পর ব্যাটটা ঘুরপাক খাওয়ালাম। ওটা কেতা। মাঠে বেশি ইমোশন দেখালাম না। ওটাও কেতা। আবার ম্যাচের পর যখন ইন্টারভিউয়ে আমায় জিজ্ঞেস করা হল, গম্ভীর বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরির অ্যাত্ত কাছে এসে ফিরে গেল, কেমন লাগছে? অন্য যে কেউ হলে আহাউহু করে সিমপ্যাথিতে টলে পড়ত, তাতে মেগানায়কের বেদী এক্সট্রা সিমেন্ট পেত, কিন্তু আমি কী বললাম? ‘ও নিজেই তো সে জন্য দায়ী!’ এটা আমার স্পেশাল কেতা। এমন ফটাং-সত্যি বলতে নেই। ঠিক সময় দুঃখু-দুঃখু হতে হয়, আবার জেতার পরেও ডিগবাজি খেতে হয়। ওই ‘হয়’গুলোকে আমি রোজ সকালে উঠে ঘণ্টাতিন লাথাই। জোশ আসে।
কখন খেলা ধরব, কখন ছাড়ব, কখন টিকিট-চেকার থেকে ভারতের ক্যাপ্টেন বনে যাব, কখন সব টান মেরে ফেলে টিকিট চেকিং-এ ফিরে যাব, কিচ্ছু হিসেব কাউকে আঁচ করতে দেব না। অনেকে বলে, আমার মুখ দেখে নাকি মনে হয়, গৌতম বুদ্ধ। সুখেও নিস্পৃহ, দুঃখেও অনুদ্বিগ্ন। তা হবে। বুদ্ধ কে ভাল জানি না, কিন্তু সে যদি আমার ইকুয়াল হয়, বেশ। কনগ্র্যাট্স রইল।
টেস্ট ছেড়ে দিলাম, তাই নিয়ে এত হইহই কীসের? টেস্ট আবার একটা খেলা? মিউজিয়ামের ফসিল। যারা চিল্লায় ‘ওটাই আসল ক্রিকেট’, তারা কি আমির খানের সিনেমা ছেড়ে কথকতা শুনতে যায়? জাঙিয়া ছেড়ে ল্যাঙট পরে? ও সব কাব্যি শুনতে খুব ভাল, পৃথিবীর দিকে যদি ঠিক করে তাকাস, দেখবি, পুরো যুগটা টি-টোয়েন্টির হাত থেকে চেটে চেটে বাতাসা খাচ্ছে, এর পর টি-টেন আসবে, তার রমরমা হবে দেড়া। টি-ফাইভ এলে তো কথা নেই। টেস্ট নিয়ে মাথা ঘামাবে শুধু ক’টা কষ্টা ক্যাবলা, এরা সব যুগেই ঠাকুদ্দার আমলকে স্বর্ণযুগ বলে ডুকরে ডুকরে ঘ্যানায়। এদের দরকার কানের গোড়ায় একটি হেলিকপ্টার ঝাপড়া!
কেউ কেউ বলছে, শ্রীনির সঙ্গে আমার দুর্নীতির কী সব ফাঁস হবে, তাই ভয় পেয়ে গেছি। ভাই, চোর বল, খুনি বল, আমাকে ভিতু বলিস না। যদি জেলে যাই, এমন রেলায় যাব, পুলিশের আঙুলে আপসে স্যালুট গজাবে। আমি মাঠে দাঁড়িয়ে তাবড় লোককে দেখিয়েছি, কিচ্ছুকে ভয় পাই না। লাস্ট ওভারে তেইশ তুলতে হবে? আছি। চব্বিশ? সেও ভি আছি। আমি বেস্ট ফিনিশার কি না, জানি না। কিন্তু মরার আগে কখনও ফিনিশ হই না, এটা জানি। হেরেছি বহু বার, আরও হারব। জিতেওছি সাংঘাতিক। পরের ওয়ার্ল্ড কাপটা তো খুব জিততে চাই। কিন্তু হারজিত নিয়ে তোদের মতো নখও চিবোই না। রাত্তির জেগে পেছনও চাপড়াই না। কমপ্লেন করি না। এক্সপ্লেন করি না।
পাবলিক আমার ওপর খেরে থাকে আমি খারাপ লোক বলে নয়, খারাপ খেলি বলেও নয়, আমার এই পাত্তা না দেওয়াটা সব সময় নাকেমুখে ঝলকায় বলে। লোকে বড় বড় আইকনের কাছ থেকে একটু পিতিরপিতির নেকুচন্দন চায়, থানে মাথা ঠোকা চায়, ‘আমি তোমাদেরই লোক’ টাইপ ধাস্টামো চায়। এই যে দেশটা জুড়ে ইয়াং লেখকরা ‘আমি লিখছি, বাকিরা ফোট!’ না-বলে খ্যাত লেখকের চরণামৃত চাটে, নতুন কম্পোজাররা ‘দেখ কাকে বলে গান’ না-বলে ডাইনোসরগুলোর নাম করেই কানে হাত ঠেকায়, এটা শিরদাঁড়াহীনতার ট্রেডমার্ক। যার আত্মবিশ্বাস তলানিতে, সে-ই অত বিনয়ী হয়। আর, ভণ্ডরা অমন করে। এই পাজির পাঝাড়া আর মেনিমুখোদের চেয়ে আলাদা হওয়ার সাধনাই আমার জীবন। শ্রদ্ধার চেয়ে অশ্রদ্ধা দামি, কারণ তা দাবড়ে বাঁচতে শেখায়। তোদের চিন্তা, দিনের শুরুতে পৃথিবীর সামনে কী করে দাঁড়াবি। আমার মিশন, দিনের শেষে নিজের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
(লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়)
আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে