২০১৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বড় জয়ের পর নরেন্দ্র মোদি অভ্যন্তরীণের চেয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলেছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রহ্মা চেলানি৷
পররাষ্ট্রনীতিতে সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি এ বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে অনেকে বিস্মিত৷ চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে উপস্থিত থাকবেন, সবাই মোদির সঙ্গে এরই মধ্যে সাক্ষাৎ করেছেন৷
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনকে ভারতে স্বাগত জানানোর পর মোদি এখন এমন সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় আছেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কারণে নতুন করে শীতল যুদ্ধ শুরুর হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে এর আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেননি৷
পাঠকের ভোটে টাইম ম্যাগাজিনের ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ মনোনীত মোদি জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের জন্যও কাজ করছেন৷ গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে৷
নির্বাচনে জেতার পর অনেকে মনে করেছিলেন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মোদি হয়ত তাত্ত্বিকতার দিকে যাবেন৷ কিন্তু তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম ট্রেডমার্ক হলো বাস্তববাদ৷ একটি ঘটনায় সেটা স্পষ্ট বোঝা গেছে৷ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি নয় বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র তার উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাকে যেভাবে অপমান করেছিল সেটা ভুলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হয়েছেন৷ ২০০২ সালে গুজরাটে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে মোদির জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে ভিসা দিতে অপারগতা জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের তদন্ত প্রতিবেদনে মোদিকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্র তার উপর থাকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি৷ তারপরও নির্বাচনে জেতার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা মোদিকে টেলিফোন করে তাকে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান৷ ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মোদি তাতে সম্মতিও দেন৷
মোদির কূটনৈতিক ঝুঁকি
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মোদির বাস্তববাদের আরেকটি উদাহরণ হলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করা৷ ভারতের অবকাঠামো, বিশেষ করে রেললাইন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শিল্পপার্ক গড়ে তোলা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে চীনের বিনিয়োগ আহ্বান করেছেন মোদি৷ ভারতে চীনের সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম৷ কারণ চীনা কোম্পানিগুলো ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করে সেখানে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী৷ চীন যে মোদির কূটনৈতিক ঝুঁকির একটি অংশ সেটা বোঝা যায়, চীনা প্রেসিডেন্টে ভারত সফরের সময় ভারতের লাদাখে চীনা সামরিক বাহিনীর ঢুকে পড়া৷
মোদির জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, কারণ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়ে ভারতে হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷ ছয় বছর আগের মুম্বই হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাকিস্তানের কারাগারে আটক সাতজন বিচার এখনও শুরু করেনি পাকিস্তান৷ উপরন্তু এই হামলার পরিকল্পনাকারী হাফিজ সাঈদ, জাতিসংঘ যাকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করেছে, তাকে একটি বড় সমাবেশ করতে সহায়তা করেছে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি সমাবেশে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে বিশেষ ট্রেনেরও ব্যবস্থা করেছে পাকিস্তান৷
মোদি অবশ্য তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং পেশাওয়ারে স্কুলে তালেবান হামলায় নিহতদের স্মরণে ভারতে স্কুলগুলোতে দুই মিনিটের নীরবতা পালনের আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন৷
বহুপাক্ষিক হয়ে যাচ্ছে ভারত
মোদির পদক্ষেপে মনে হচ্ছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভারত এখন বহুপক্ষীয় সম্পর্কের অনুসারী হতে যাচ্ছে৷ বিভিন্ন স্বার্থে পৃথক শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে ভারত শুধু এগিয়েই যাবে না, এটা তার কৌশলগত সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহায়তাও করবে৷
তবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ করতে গিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন এমন না হয় যে, কোনো এক সময় শুধুমাত্র একটি দেশকে বেছে নেয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়৷ যেমন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে৷ শীতল যুদ্ধের সময়কার ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের জায়গায় স্থান হয়েছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের৷ ভারতের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে রাশিয়া যে দিন দিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এবং সামরিক চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কোন্নয়নের ঝুঁকি সম্পর্কে মোদিকে ভাবতে হবে৷
পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধ
যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপ ও এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যমে ভারত বহুপক্ষীয়তার দিকেই এগোচ্ছে৷ এর বাইরে ভারত তার নিজস্বতার দিকেও খেয়াল রাখছে৷ যেমন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কর্মসূচিতে যোগ দেয়নি ভারত৷
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভারত এমনিতে প্রকৃতিগতভাবে পূর্ব-পশ্চিম এবং ইউরোপ-এশিয়ার মধ্যে সেতু হয়ে আছে৷ গতিশীল পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে ভারত সত্যিকার অর্থে পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধ হয়ে উঠতে পারে৷
ব্রহ্মা চেলানি: নতুন দিল্লির ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক৷