দুর্নীতি দমনে সমন্বিত অভিযান জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআরসহ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে এ কাজে আরো সক্রিয় করা হবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের এই সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতির সঙ্গে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নাম ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসার পর এ নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়, যা সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর দুর্নীতি দমনে সমন্বিত কার্যক্রম জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কার্যক্রম মনিটর করবেন বলে জানা গেছে। তিনি উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে এবং সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন দেখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য দুর্নীতিবাজদের একটি তালিকা তৈরি করবেন। ওই তালিকা দুদক, এনবিআরসহ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরেও আনা হবে।
হঠাৎ করে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। আর এ অপরাধে জড়িত সরকারদলীয় কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী, যার দায় এসে পড়েছে সরকারের ওপর। তাই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধ এবং সরকারি দলের দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের লাগাম টেনে ধরতে সমন্বিত এ অভিযান পরিচালনা করা হবে। সরকারের সমন্বিত এই কাজের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করে এ অপরাধ থেকে তাঁদের দূরে রাখা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম অন্য সংগঠনগুলোর কিছুসংখ্যক নেতাকর্মীর কারণে জনমনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তা সরকার নিরসন করতে চায়।
চাঁদাবাজির অভিযোগে গত শনিবার ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদচ্যুত করা হয়। গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে যুবলীগের দুই নেতার দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিতর্কিত নেতাদের ব্যাপারেও অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেন। এরপর গত বুধবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে। সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এর পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জোরালো করবে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বুধবার ধানমণ্ডিতে দলের সভাপতির কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ কিংবা দলের সহযোগী সংগঠনের কোনো নেতা দুর্নীতি করলে দুদক ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বলা আছে। অপরাধ করে আওয়ামী লীগের কেউ পার পাবেন না। এর আগে গত সপ্তাহে সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সরকারি দলের এমপিদের বিরুদ্ধেও দুদক চার্জশিট দিয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর একাধিক এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। অভিযুক্তরা জামিনের জন্য সহযোগিতা চাইলেও তাঁদের কথা শোনেননি বলে দাবি করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান এমপি গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে সরকারের চলমান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অ্যাকটিভ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সরকার সেটাই করছে। আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা রক্ষা করতে চাই।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, “দুর্নীতির বিষয়ে পত্রপত্রিকায় যেসব সংবাদ ছাপা হচ্ছে, তা আমরা দেখছি। আমাদের নিজস্ব ‘প্রসেস’ অনুযায়ী এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।”
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ছাত্রলীগের পদচ্যুত দুই নেতা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দুর্নীতির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে সংবাদমাধ্যমে তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ এসেছে সে সম্পর্কে তিনি অবগত।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে এ সরকারের আমলেই দুর্নীতির মামলা করেছে দুদক। সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুদক দুর্নীতির মামলা করে। কক্সবাজারের বহুল আলোচিত সরকারদলীয় সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি দুদকের মামলায় কারাগারে ছিলেন। এরপর তিনি দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হন। শেরপুরের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ আতিউর রহমান আতিক এবং নরসিংদীর সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খানের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করেছে দুদক। প্রতিষ্ঠানটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি আবদুল ওদুদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করছে।