যে লড়াইয়ের মীমাংসা হয়েছিল বিশ্বকাপে এসে

SHARE

‘১০০’ অঙ্কটা বোলারদের জন্যও যে আকর্ষণীয় হতে পারে, তা প্রমাণ করেছিলেন শোয়েব আখতার ও ব্রেট লি। ক্রিকেট ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরেই দ্রুততম ডেলিভারির মালিক ছিলেন জেফ থমসন। একটুর জন্য ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বল করা হয়নি তাঁর। গবেষণাগারে মাপা তাঁর সেই ডেলিভারিটিকে শেষ পর্যন্ত কে ছাপিয়ে যাবেন, তা নিয়ে শুরু হয় রোমাঞ্চকর এক লড়াই। বিশ্বকাপ নিয়ে ফিরে দেখার সপ্তম পর্ব। লিখেছেন সঞ্জয় বসাক
আধুনিক ক্রিকেটে সত্যিকারের ‘স্পিড স্টার’-এর তালিকা করতে গেলে দুজনের নাম আসবে একদম ওপরের দিকে। গতির লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার একটা অলিখিত, কিন্তু স্পষ্ট লড়াই চলেছে দুজনের মধ্যে। ঘণ্টায় ১০০ মাইল—ক্রিকেটের একসময়ের রোমাঞ্চকর শব্দবন্ধ বানিয়ে তুলেছিলেন। শোয়েব আখতার আর ব্রেট লির রোমাঞ্চকর সেই লড়াইয়ে শেষ হাসিটা রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেসের মুখেই ফুটেছিল, তাও আবার ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চ—বিশ্বকাপে!

১৯৯৯-এর ডিসেম্বরে ব্রেট লির আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত শোয়েব ছিলেন তখনকার ক্রিকেটের সবচেয়ে গতিশীল বোলার। লির অভিষেকের আগে ওই বছরেই শারজায় ঘণ্টায় ১৫৪.৫ কিমি (৯৬ মাইল/ঘণ্টা) গতিতে বল করেছিলেন। আগের বছর ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও একই গতিতে বল করার নজির ছিল তাঁর। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে আবারও নিজের গতির তোপ দাগেন প্রোটিয়াদের উদ্দেশে। এবার গতি ঘণ্টায় ১৫৩ কিমি (৯৫ মাইল/ঘণ্টা)। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেছিলেন টুর্নামেন্টের দ্রুততম ডেলিভারিটি, আরও একবার নিজের সর্বোচ্চ গতি ১৫৪.৫ কিমি. (৯৬ মাইল/ঘণ্টা) স্পর্শ করলেন।

বারবার ঘণ্টায় ১০০ মাইলের সেই মাইলফলকের কাছে এসে শোয়েব যে উসকে দিচ্ছিলেন। নিজেকে, তাঁর ভক্তদেরও। কবে হবে, কখন হবে সেই ডেলিভারি? কিন্তু শোয়েব জানতেন না, লড়াইটা শুধু স্পিডগান বনাম তাঁর বাহুর জোর নয়। এক স্বর্ণকেশীও ঢুকে পড়ছে এর মধ্যে!

১৯৯৯ সালের অক্টোবরে ডেনিস লিলি ২২ বছর বয়সী আনকোরা এক অস্ট্রেলিয়ান গতিতারকার আগমন ঘোষণা দিলেন। ১৯ বছর বয়সেই ঘণ্টায় ১৪৮ কিমি (৯২ মাইল/ঘণ্টা) বেগে বল করেছেন। তখনো বিশ্ব তাঁর নাম ঠিকমতো জানেনি। তবে ওই বছরের শেষে একনামে সবাই চিনে নিল তাঁকে—ব্রেট লি।

অভিষেক টেস্টেই ১৫৪.১ কিমি/ঘণ্টা গতিবেগে বল করে লি জানান দিলেন, শরীরটা দেখতে পলকা হলে কী হবে, জোর আছে তাঁর কবজিতে। একদিকে শোয়েব, আরেকদিকে লি- দুজন মিলে নিয়মিত ১৫০ কিমি/ঘণ্টার ওপরে বল করে ব্যাটসম্যানদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেন। কিন্তু কেউই ১০০ মাইলের সেই ম্যাজিক অঙ্কটা ছুঁতে পারছিলেন না।

২০০০ সালের ২৩ জানুয়ারি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম দ্রুততম স্পেলটি করলেন লি। বলের গতিবেগ ১৫০-১৫৪ কিমি/ঘণ্টা উঠতে লাগল নিয়মিতই, সর্বোচ্চ ১৫৪.৮ কিমি/ঘণ্টা স্পর্শ করলেন দুবার। ওই স্পেলে করা তাঁর তৃতীয় ওভারটির প্রতিটি বলের গতি ছিল ১৫২ কিমি/ঘণ্টার ওপরে। ওই ওভারের গড় গতি ছিল ১৫৩.৯ কিমি/ঘণ্টা!

কিন্তু শোয়েবও পিছিয়ে থাকার পাত্র নন। ওই বছরই শারজাতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৫৬ কিমি/ঘণ্টা (৯৭ মাইল/ঘণ্টা) গতিতে বল করে লির চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। দুই সপ্তাহ পরে একই কাজ করে দেখালেন লিও। একই ম্যাচে দুবার ১৫৬ কিমি/ঘণ্টা গতি তুললেন। বিশ্বের দুই প্রান্তে দুজনের মধ্যে গতির লড়াই তখন তুঙ্গে।

গতির লড়াইয়ে নেমে দুজনকেই বারবার যেতে হয়েছে অপারেশন টেবিলে, মাঠের বাইরে বসে থাকতে হয়েছে অনেক দিন। কিন্তু তবুও গতির সঙ্গে কোনো প্রকার আপস করেননি দুজনের কেউই। ইনজুরি-নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে শোয়েব ফিরলেন ২০০০-এর ডিসেম্বরে। মাঠের বাইরে থাকলেও গতির নেশায় যে এক ফোঁটা মরচে ধরেনি, তার প্রমাণ দিলেন কিছুদিন পরই। আগের গতিকে ছাড়িয়ে এবার তুললেন ১৫৭.২ কিমি/ঘণ্টা (৯৭.৭ মাইল/ঘণ্টা)। জেফ থমসনের বিশ্ব রেকর্ড (১৬০.৪৫ কিমি/ঘণ্টা বা ৯৯.৭২ মাইল/ঘণ্টা) ভাঙার পথে লিকে ছাপিয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন শোয়েব।

মাঝে বেশ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও লি আবার সদর্পে ফিরে এলেন ২০০২ এর জানুয়ারিতে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গতি তুললেন ১৫৪.৬ কিমি/ঘণ্টা। ২০০০-এর এপ্রিলের পর এটিই ছিল লির দ্রুততম ডেলিভারি। তবে মাসখানেক পরই শোয়েবকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান নিজের করে নিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে লির হাত থেকে বেরোল ১৫৭.৪ কিমি/ঘণ্টার গোলা। একই টেস্টে ১৫৭.৩ কিমি./ঘণ্টায়ও বল করলেন। প্রায় দেড় বছর পিছিয়ে থাকার পর এক টেস্ট দিয়েই তাই শোয়েবকে দুবার পেছনে ফেলে দিলেন লি।

তবে লিকে বেশি দিন চূড়ায় থাকতে দিলেন না শোয়েব। মাস দু-একের মধ্যেই লির রেকর্ড চূর্ণ করে নিজেকে নিয়ে তুললেন নতুন উচ্চতায়। ১২ এপ্রিল ঘণ্টায় ১৫৯.৫ কিমি বেগে বল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। মাত্র ৫ দিন পরেই, ১৭ এপ্রিল বল করলেন ১৫৯ ও ১৫৮.৪ কিমি/ঘণ্টা বেগে।

তবে এরপর আর লি নন, শোয়েব নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০২ সালে এক ওয়ানডেতে ১৫৯.৯ কিমি/ঘণ্টার মিসাইল বের হলো তাঁর আস্তিন-কামান থেকে। বিশ্ব রেকর্ড তখন শোয়েবকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

ওই সিরিজেরই তৃতীয় ওয়ানডেতে সবকিছু ছাপিয়ে গেলেন শোয়েব। ১৬১ কিমি/ঘণ্টায় বল করে শোয়েব তখন বিশ্ব রেকর্ডের দাবিদার। কিন্তু শোয়েবের এই বলকে দ্রুততম বলের স্বীকৃতি দিতে রাজি হলো না আইসিসি। সাধারণত তখন ম্যাচে বলের গতি মাপা হতো ইডিএইচ রাডার দিয়ে। কিন্তু ওই ম্যাচে ইডিএইচ রাডার না থাকায় বলের গতি মাপার দায়িত্বে ছিল সাইবারনেট নামক একটি কোম্পানি। এই কারণে বলটিকে দ্রুততম বলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি আইসিসি।

কিন্তু সেই আক্ষেপ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি শোয়েবের। বরং বেছে নিলেন আরও বড় মঞ্চ। বিশ্ব রেকর্ড ঠিকই করলেন, সেটিও বিশ্বকাপে! ২০০৩ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে নিক নাইটকে ১৬১.৩ কিমি/ঘণ্টা (১০০.২ মাইল/ঘণ্টা) গতিতে বল করে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম ডেলিভারিটি করেন। তাঁর আগে কেউ ১০০ মাইলের এই গণ্ডি পেরোতে পারেনি।

শুধু ওই বলটিই নয়, শোয়েবের সেই ওভারটিই এখনো পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম ওভার। ওভারের ছয়টি বলের গতি ছিল এ রকম: ১৫৩.৩, ১৫৮.৪, ১৫৮.৫, ১৫৭.৪, ১৫৯.৫ ও ১৬১.৩। গড় গতি ১৫৮.০৬ কিমি/ঘণ্টা!

ক্যারিয়ারে শেষ পর্যন্ত শোয়েবকে ছাড়াতে না পারলেও ছাড়ানোর খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন লি। ২০০৫ সালে নেপিয়ারে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১৬১.১ কিমি/ঘণ্টা গতিতে বল করেছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান। তবে তাঁর এই ডেলিভারিটিও ১০০-এর বেশি ম্যাজিক অঙ্ক ছোঁয়।