ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে অনবদ্য গ্রন্থ

SHARE

সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করতে কিংবা এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্ক গড়তে বিরাট ভূমিকা রাখে খাদ্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাস। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।

দেশটির সামাজিক কাঠামোতে খাদ্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের প্রভাব অত্যন্ত দৃঢ়। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বরুদ গুপ্ত ও দেবাং সিং রচিত বইটির শিরোনাম ‘ভগবান কি পাকওয়ান’। এতে উপস্থাপন করা হয়েছে খাদ্য সংস্কৃতি কীভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে খাদ্য একসঙ্গে সম্প্রদায়গুলিকে যুক্ত করতে পারে এবং প্রজন্মান্তরে কীভাবে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়।

‘ভগবান কি পাকওয়ান’ একটি রান্নার বই-কাম-ভ্রমণ বৃত্তান্ত যা ভারতের রান্নার ঐতিহ্যকে অন্বেষণ করে, বিশ্বাসের চারপাশে ঘুরে আসা বিভিন্ন পরিচিত সংস্কৃতির কাছে দেশটির মানুষকে উপস্থাপন করে এবং তাদেরকে খাদ্য ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেয় যে বিষয়ে মানুষ ধারণা পোষণ করে খুবই কম।

১। রাইস বিয়ার অ্যান্ড দ্য কার্বি ট্রাইব অব মেঘালয়
বইটিতে মেঘালয়ের কার্বি উপজাতির খাদ্য সংস্কৃতিও উপস্থাপন করা হয়েছে। ব্যাখ্যা করা হয়েছে কীভাবে খাদ্য তাদের বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই উপজাতির প্রধান খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো রাইস বিয়ার, যা দেবতাদের কাছে এক সত্যিকার খাবার আইটেম হিসেবেও বিবেচিত হয়।

চাল কার্বি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুয়োরের মাংস, মহিষের মাংস, মুরগির মাংস, মাছ এবং কীটপতঙ্গসহ একাধিক প্রোটিন দিয়ে রান্না করা হয়। তাদের রন্ধন ও জীবনধারায় বাঁশও একটি প্রধান উপাদান। এটি খাওয়া হয়, রান্না হয়, চাষ করা হয়, এটি দিয়ে নির্মাণকাজ করা হয় এবং জ্বালানি ও রাইস বিয়ার খাওয়ার কন্টেইনার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

এখানকার স্থানীয় খাবারগুলো যেমন শূকরের মাংস এবং সবুজ শাক, বাঁশ এবং সিকেদা চাটনি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে।

২। দ্য সল ফুড অব উদভেদা
বইটিতে বর্ণনা অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী এ খাদ্য সংস্কৃতি এসেছে পারস্য থেকে। গুজরাট উপকূলে ছোট্ট শহর উদভেডা সবসময় জরোস্ট্রিয়ান বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের কেন্দ্র ছিল। এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খাদ্য ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো সল ফুড। কোনো দেবতা বা অগ্নিতে এ নৈবেদ্য তৈরি করা হয় না। এর পরিবর্তে সেই ব্যক্তির আত্মাকে দেওয়া হয় যার মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য, কঠোর প্রক্রিয়া এবং গম, গোলাপ, চন্দন কাঠ, দুধ ও তামার মতো নির্দিষ্ট উপাদানগুলো প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী আত্মার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পারস্য খাদ্য সংস্কৃতির এটি কেবল একটি অংশ।

পারস্য খাবারের বৃহত্তর নীতি হলো খাতু-মিথু-তিখো বা টক-মিষ্টি-মসলাযুক্ত স্বাদ। মনে করা হয় বছরের পর বছর ধরে ভারতজুড়ে খাদ্য সংস্কৃতিতে যেসব খাবার প্রভাব ফেলেছে সেগুলো হলো স্থানীয় গুজরাটি খাবার, বোম্বে থেকে আসা পর্তুগিজদের গোয়ান ফুড এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভাবিত পারস্য খাদ্য সংস্কৃতি- এইসব বিষয়গুলো নিয়ে গড়ে ওঠে দ্য সল ফুড অব উদভেদা।

৩। দ্য ফেইডিং কমিউনিটি অব কলকাতা’স জিউস অ্যান্ড শাবাত
বইটির লেখক বরুদ এবং দেবাং যখন কলকাতা ভ্রমণ করেন তখন তারা যেসব তথ্য উপাত্ত পান সে অনুযায়ী, শহরটিতে বাগদাদি ইহুদিদের কাছ থেকে এ খাদ্য সংস্কৃতি এসেছে। বহুকাল আগে ওই সম্প্রদায়টি সেখান থেকে চলে গেছে। কিন্তু আজো টিকে আছে তাদের রেখে যাওয়া খাবার সংস্কৃতি।

কলকাতার ইহুদিদের মধ্যে এই খাদ্য সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান। শহরটির ইহুদি সম্প্রদায় ধর্মীয় দিন শাবাত পালন করে শনিবার। ওইদিন তাদের বিশ্রামের দিন। শুক্রবার রাতের বেলা শুরু হয় এ বিশেষ ভোজপর্ব। চলে শনিবার রাত পর্যন্ত।

শাবাত উৎসব সাধারণত শুরু হয় ব্রেকিং ব্রেড দিয়ে যা চাল্লাহ নামে পরিচিত। ব্রেকিং ব্রেড লবণ দিয়ে এক কাপ মদ পানের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। এর সঙ্গে থাকে হিলবেসহ আলু মাকাল্লাহ, জালাতা (শসার সালাদ), মহাশাস (সবজি দিয়ে তৈরি) এবং মুরগির রোস্ট দিয়ে। এরপর কুবা অথবা মাংসের তরকারি দিয়ে বিশেষ পোলাও খাওয়া হয়।

৪। দ্য ফিফটি সিক্স কোর্স মহাপ্রসাদ অব জগন্নাথ টেম্পল
পুরির জগন্নাথ মন্দিরের ভেতর আপনাকে রীতিমতো প্রশ্নের সম্মুখীন করবে তা হলো জগন্নাথ কী মানুষ নাকি দেবতা। আপনার নিজের মতো জগন্নাথেরও প্রতিদিনের কিছু রুটিন রয়েছে। যেমন হাঁটাহাঁটি করা, দাঁত ব্রাশ করা, গোসল করা, বিশ্রাম নেওয়া, ৫৬ পদ দিয়ে রান্না ছয় রকমের খাবার গ্রহণ। সকাল ৯টায় গ্রহণ করা ব্রেকফার্স্ট- যা গোপাল বল্লভ ভোগ নামে পরিচিত- তৈরি হয় পেডা, কোরা এবং হরেক রকমের ফল দিয়ে।

এরপর মধ্যমভোগ বা মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করা হয় দুপুরে এবং সন্ধ্যা ৭টায় সন্ধ্যায় টিফিন যা সন্ধ্যা ভোগ নামে পরিচিত। অবশেষে দিনটি ধুপের মধ্য দিয়ে শেষ হয়, যাতে রয়েছে একটি সিলভার কন্টেইনারে খাঁটি ঘি-এর ব্যবহার।

৫। দ্য ব্রেকফার্স্ট অব চ্যাম্পিয়ন্স অ্যাট কাই গম্পা
তিব্বতি ভিক্ষুদের মধ্যে প্রধান খাদ্য সংস্কৃতির একটি হলো ব্রেকফার্স্টের সঙ্গে মাখন চা এবং পাক নামের আইটেম। লেখক মাখন চায়ের বর্ণনা করেছেন এভাবে, একটি প্রকাণ্ড পাত্রে খাঁটি ঘি, খাঁটি দুধ, লবণাক্ত চায়ের পাতা ব্যবহার করে এটি প্রস্তুত করা হয়। অন্যদিকে, পাক হলো ঘিয়ের সঙ্গে সাতু এবং চিনির সঙ্গে মাখন মিশিয়ে তৈরি মালকড়ির মতো উপাদান।

বইটির দুটি সেরা জিনিস হলো দর্শনীয় ছবি, প্রতিটির বিস্তারিত বিবরণ এবং শেষের দিকে রেসিপি।

সূত্র : ইন্ডিয়া টাইমস