পাকিস্তানে তালেবানের সঙ্গে গোপন বৈঠকে সৌদি যুবরাজ!

SHARE

ঐতিহাসিক এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে চলমান পাকিস্তান সফরে সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আফগান জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান নেতাদের সাথেও বৈঠক করতে পারেন বলে খবর দিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। আজই সেই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

পাকিস্তানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদেই তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন সৌদি যুবরাজ।

নাম প্রকাশ না করা ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘পাকিস্তান সফরের সময় ১৮ ফেব্রুয়ারি তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হবে যুবরাজে। তবে বিষয়টি এখনো সর্বোচ্চ গোপনীয়।’

তালেবানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুবরাজের সঙ্গে এই বৈঠকের কোনো এজেন্ডা তৈরি হয়নি। তবে তালেবান প্রতিনিধিরা পাকিস্তানের রাজধানীতেই আছেন।

তালেবানের প্রতিনিধি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে যুবরাজকে এই পরিকল্পনায় দেখা হচ্ছে না, তবে আমরা যেহেতু ইসলামাবাদে আছি তাই আলোচনা করতে পারি।’

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানে কেন সৌদি যুবরাজ-তালেবান বৈঠক হচ্ছে?

আফগানিস্তানের সাথে সৌদি আরবের সংশ্লিষ্টতা কয়েক দশকের পুরনো। আশির দশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সাথে মিলে কাজ করেছিল সৌদি আরব।

সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর দেশ যখন গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে, রিয়াদ তখন জঙ্গিদের প্রতি দেয়া সমর্থন প্রত্যাহার করে তালেবানকে সমর্থন দেয়। পাকিস্তান ও আরব আমিরাতের বাইরে সৌদি আরব তৃতীয় দেশ যারা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

কিন্তু ৯/১১ এর ঘটনার পর, রিয়াদ তালেবানদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বাধীন নতুন আফগান প্রশাসনকে সমর্থন দেয়। তবে, ধনকুবের সৌদিদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থ সহায়তা পেয়ে এসেছে তালেবানরা।

২০০০ সালের দিকে আফগানিস্তান আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে ইরানের ভূমিকা এখানে বাড়তে থাকে। রিয়াদও তাই তাদের সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে থাকে। ২০০৮-২০০৯ সালে তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করে সৌদি আরব।

সৌদি আরবের অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ ও হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে আফগানিস্তানে। তেহরানের প্রভাবকে টেক্কা দিতেই এইসব করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ঘানির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে রিয়াদের। সরকার গঠনের পর প্রথম দেশ হিসেবে সৌদি আরব সফর করেছিলেন ঘানি এবং নতুন সৌদি-নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস-বিরোধী জোটেও যোগ দিয়েছেন তিনি, যে জোটে কাতার ও ইরান নেই।

আফগানিস্তানে রিয়াদের অধিকাংশ স্বার্থই ইরানের সাথে জড়িত। ভূমধ্যসাগরে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কাতারও একটি বিষয়।

২০১১ সালে সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং কাতার তালেবানদের রাজনৈতিক অফিসের জায়গা দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করেছিল। সৌদি ও আমিরাত শর্ত দিয়েছিল যে, আল কায়েদাকে প্রত্যাখ্যান এবং আফগান সংবিধানকে মেনে নিলে তারা অফিসের জায়গা দেবে। কাতার এ ধরনের কোনো দাবি জানায়নি এবং ২০১৩ সালে দোহাতে এই অফিসের যাত্রা শুরু হয়।

এর পর থেকেই সৌদি আরবের সাথে কাতারের শত্রুতা বেড়েছে। ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের মধ্য দিয়ে এর ইতি ঘটেছে। কাতারকে আরও একঘরে করার প্রচেষ্টা হিসেবে এবং আফগানিস্তানে কাতারের প্রভাব কমানোর জন্য রিয়াদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দোহার তালেবান অফিস বন্ধ করে দিতে বলেছে।

চলতি আফগান শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে সৌদি আরব ইরান ও কাতারকে দমনেরও চেষ্টা করছে। যে শান্তি প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-পাকিস্তান মিলে আফগানিস্তানের ১৭ বছরের যুদ্ধ অবসানের চেষ্টা করছে।

গত মাসেই সৌদি সফরের আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কাতারও সফর করেন। সেখানে দোহার সঙ্গে একটি বড় মাপের গ্যাস চুক্তি সাক্ষর করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস চুক্তির আড়ালে কাতারের সঙ্গে তালেবান-সৌদি বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন ইমরান। যেহেতু, কাতার-সৌদি আরব ও তালেবান-সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক পাকিস্তানের।

সৌদি-কাতার সফরের আগে আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন ইমরান খান।

এর পেছনে আরও একটি কারণের কথা বলা হচ্ছে। পশ্চিম থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়ে পূর্বমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে সৌদি আরব। যার মূল কেন্দ্রে পাকিস্তান ও চীন।

বিশেষ করে গত অক্টোবরে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে সৌদি যুবরাজের।

তাছাড়া গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি মন্তব্যও সূচ হয়ে বিঁধছে সৌদিকে। তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন ‘সৌদি সাম্রাজ্য আর সৌদি বাদশা মার্কিন সাহায্য ছাড়া দুই সপ্তাহও টিকবে না।’

গ্লোবাল ভিলেজ ভিউজ ও খালিজ টাইমস ও আরব নিউজসহ বেশকিছু সংবাদমাধ্যম জানায়, ট্রাম্পের ওই মন্তব্য ভালোভাবে নেননি সৌদি বাদশাহ। তাই মার্কিনিদের ওপর ভরসা কমাতে পূর্বমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে সৌদি।

যেখানে নিজের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান (সৌদির সীমানা পাহাড়া ও সেদেশের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয় পাকিস্তানি সেনারা) ও বিনিয়োগ এবং ব্যবসার জন্য চীনের কাছাকাছি হতে চাইছে তারা।

সম্প্রতি ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডদের সাথে তালেবানের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে পাশ্চাত্য ও আফগান সূত্রগুলো দাবি করছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীকে বিদায় করতেই ইরান-তালেবান সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

ফলে তালেবানের ওপর ইরানের প্রভাব কেমন হবে এবং তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় গেলে ইরান-সৌদির ব্যাপারে তাদের অবস্থান কেমন হবে এই বৈঠকে সেটাও জানার চেষ্টা করবেন যুবরাজ। বিশেষ করে সেটা তালেবানের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করা পাকিস্তানকে সাক্ষী রেখেই।

যুবরাজ-তালেবান সাক্ষাতের পেছনে আছে ভারত প্রসঙ্গও। কয়েকদিন আগে ‘মানিকন্ট্রোল’ নিউজ জানায়, সালমান প্রথমবারের মতো ভারত সফরে যাচ্ছেন। তবে তার আগে পাকিস্তানসহ আরো কয়েকটি সফর শেষ করবেন তিনি।

পাকিস্তান থেকে সৌদি যুবরাজ মালয়েশিয়া যাবেন। পরে দেশে ফেরার পথে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে অবতরণ করবেন।

প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, ক্রাউন প্রিন্স মালয়েশিয়া সফরের পর ভারতে পা রেখে বুঝাতে চাচ্ছেন যে তার দেশ ভারতকে আলাদাভাবে বিবেচনা করছে না।

জ্বালানি থেকে ম্যানুফেকচারিং পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে সৌদি আরবের সহায়তা কামনা করে আসছে ভারত। অন্যদিকে সৌদি আরব তার কিদ্দিয়া বিনোদন সিটিতে ভারতীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে। এই বিনোদন কেন্দ্রে থিম পার্ক ও রেস ট্রাকসহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে।

তাছাড়া ভারতের শীর্ষ তেল রফতানিকারক সৌদি আরব। ইরান ও ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সৌদি আরব ভারতের তেল বাজারের বড় অংশ দখল করতে চাচ্ছে। ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার সৌদি আরব।

দি স্ট্র্যাইটস টাইমসে সাংবাদিক নির্মলা গানাপাথি লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান তালেবানের মধ্যে চলমান শান্তি আলোচনা ভারতের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

যুবরাজের এই সফরকে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে সবচেয়ে বড় সফরের তকমা দিলেও ভারত শাসিত কাশ্মীরে গত বৃহস্পতিবার ভারতের কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর উপর জঙ্গি হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতে পা রাখার আগে সৌদি যুবরাজ তালেবানদের কাছ থেকে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের জন্য ইতিবাচক কোনো বার্তা নিয়ে যেতে পারেননি কিনা- সেই চেষ্টাও হয়তো করবেন।