আপনাদের ইতিমধ্যে জানার কথা, ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের আবোলতাবোল কথা বলার প্রবণতা আছে। আগেও তিনি দায়িত্বহীন কথা বলেছেন। এবার বলেছেন আসামে অনুপ্রবেশ নিয়ে। সাম্প্রতিক এক মন্তব্যে রাওয়াত দাবি করেছেন, আসামে বদরুদ্দিন আজমলের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)-এর প্রভাব বিজেপির চেয়ে বাড়ছে। ভারতকে অস্থির করতে পাকিস্তান ও চীন এককাট্টা হয়ে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানদের আসামে ঢোকাচ্ছে বলেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
রাওয়াতের এই মন্তব্য এখতিয়ারবহির্ভূত। পুরোদস্তুর অজ্ঞতাপ্রসূত। আসামের রাজনীতিতে কে কতটা জনপ্রিয়, তা নিয়ে রাওয়াতের মন্তব্য করার কোনো এখতিয়ার নেই। একটি দল অন্যটির চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ার নানা কারণ থাকতে পারে।
নির্বাচনের ফলাফলের কারণ ব্যাখ্যা করা রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের কাছেও জটিল বিষয়। আসাম রাজ্যসভার গত তিন বছরের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, কংগ্রেস, এআইইউডিএফ ও বিজেপি-এই তিন দলেরই আসন ওঠানামা করেছে। ২০০৬, ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে আসামে কংগ্রেস পেয়েছিল যথাক্রমে ৩১, ৩৯ ও ৩১ শতাংশ ভোট। এআইএইউডিএফ পেয়েছিল যথাক্রমে ৯, ১২.৬ ও ১৩ শতাংশ এবং বিজেপি পেয়েছিল যথাক্রমে ৯, ১২ ও ২৯.৫০ শতাংশ ভোট। একসময়ের বড় দল এজিপির জনপ্রিয়তা কমতে কমতে ২০০৬ সালে ২০ শতাংশে, ২০১১ সালে ১৬ শতাংশে এবং ২০১৬ সালে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যান্য দলের জনপ্রিয়তাও ধসের মুখে পড়েছে। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্বই বিলীন হতে চলেছে।
এই পরিসংখ্যান জানিয়ে দেয়, রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতনের নেপথ্যে অন্য দেশ থেকে অনুপ্রবেশ করা লোকজনের চেয়ে দলগুলোর নিজ নিজ কার্যক্রমের ভূমিকা বেশি। এটা বলা যাবে না যে আসামে অনুপ্রবেশ ঘটে না। ব্রিটিশ রাজত্বেও বাংলা একই ভূখণ্ডে ছিল; এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে যাওয়া-আসাকে ব্রিটিশ সরকার উৎসাহ দিত এবং সেই ধারা পরবর্তী সময়ে জারি থাকা খুবই স্বাভাবিক।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর দুই ভূখণ্ড আলাদা হয়। পরে ভারত সরকার ১৯৭১ সালের আগে আসামে বসত গড়ে তোলা সবাইকে নিজের নাগরিক বলে মেনে নেয়। আশির দশকে আসাম গণপরিষদের নেতৃত্বে ‘বঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন হয়। এর মধ্য দিয়ে কথিত অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত অথবা অন্য কারও হাতে এমন প্রমাণ নেই, যা দিয়ে বলা যায়, পাকিস্তান ও চীন বাংলাদেশ থেকে আসামে লোক ঢোকাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের পুরোটাই বেড়া দিয়ে ঘেরা। এরপরও যদি সেনাপ্রধান নিরাপত্তা-সংকটের আশঙ্কা করেন, তাহলে তিনি বিএসএফ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
বর্তমানে এমন কোনো অবস্থা দৃশ্যমান নেই, যাতে মনে হবে বাংলাদেশ আসামের এই তথাকথিত অভিবাসীদের নিতে রাজি আছে। সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন, যেহেতু তাদের আর বের করে দেওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তাদের মূল স্রোতে একীভূত করা এবং সমস্যা সৃষ্টিকারীদের আলাদা করা দরকার।
বর্তমানে আসামে অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করার কাজ ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে। কিন্তু এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। কাজটি কীভাবে করা হবে, তা সেনাবাহিনীর বিবেচ্য নয়।
গত জানুয়ারিতে সেনাপ্রধান জম্মু ও কাশ্মীরের শিক্ষানীতি সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন। তিনি সেখানকার মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বর্তমানে বিশেষ অবস্থা বিবেচনায় সেখানে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে এখনো সামরিক শাসন জারি করা হয়নি, যার বলে তিনি সেখানকার শিক্ষা সংস্কারের কথা বলতে পারেন। আমরা সবাই জানি, সেখানে বিজেপি ও পিডিপি জোটের একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকার আছে। এর আগে ২০১৭ সালের গোড়াতে রাওয়াত কাশ্মীরের সব আন্দোলনকারীকে ‘সন্ত্রাসীদের মাঠপর্যায়ের কর্মী’ বলে বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন। সহিংস আন্দোলন ও সশস্ত্র জঙ্গিদের সহিংস কর্মকাণ্ডকে এক করে দেখার ফল ভালো হয়নি। এভাবে বিবেচনা করে অভিযান চালানোয় কাশ্মীরের অনেক জঙ্গি যেমন মরেছে, তেমন অনেক জওয়ানকেও জীবন দিতে হয়েছে। সব আন্দোলনকে সন্ত্রাস হিসেবে দেখার ফলে অহিংস আন্দোলনকারীরাও সহিংসতার দিকে চলে যাচ্ছে।
রাওয়াতের একের পর এক বিতর্কিত কথাবার্তায় মনে হচ্ছে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মজা পাচ্ছেন। এতে একদিকে মনে হচ্ছে, সরকারের দিক থেকে তাঁকে ঠিকমতো তদারক করা হচ্ছে না, অন্যদিকে মনে হচ্ছে, অবসরের পরে রাজনীতিতে আসার অভিলাষ তিনি সামলাতে পারছেন না। তাই সেটারই আগাম জানান দিচ্ছেন। ভারতের জন্য এই দুটি আশঙ্কাই ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মনোজ যোশি: নয়াদিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিসটিংগুইশড ফেল