বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি: নতুন এলাকা প্লাবিত, কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি

SHARE

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। কয়েক জেলার নিম্নাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হবে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। খাদ্য সংকট, পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন কবলিত এলাকার মানুষ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।

সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ তত্পরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে জানিয়েছে দুর্গতরা। কোনো কোনো স্থানে ত্রাণ বিতরণের সময় দুর্গতদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের সব প্রস্তুতি রয়েছে। ’

সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। ১৩টির মধ্যে ৯ উপজেলাই বন্যাকবলিত। আজও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি কমতে থাকায় বিয়ানীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কুড়িগ্রামের প্রধান-প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাইবান্ধায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফেনীর সোনাগাজীতে স্লুইস গেট বিলীন হয়ে হয়ে গেছে।

কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ায় অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চন্দনাইশে শঙ্খ নদীতে ভেসে আসা লাকড়ি কুড়াতে গিয়ে স্রোতে এক নারী ভেসে গেছেন। বান্দরবান পৌর এলাকা, লামা ও আলীকদম উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিস্তারিত আমাদের আঞ্চলিক অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে :

সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিয়ানীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঢল অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আজ মঙ্গলবার ফেঞ্চুগঞ্জে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী  মায়া বলেছেন, ‘সিলেটের বন্যার্ত মানুষের জন্য নতুন করে ৫০০ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। সরকার বন্যা দুর্গতদের জন্য সম্ভব সব কিছু করবে। কেউই না খেয়ে মারা যাবে না। ’

মঙ্গলবার বিয়ানীবাজার উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘বন্যাকবলিত মানুষ ঘরে ফেরার পরও তাদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। ’

এদিকে সিলেট গোলাপগঞ্জ উপজেলার বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যরা অর্থ আদায় করছেন বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় লোকজন। তারা বলে, ‘ইউপি সদস্য হারুন অর রশিদ ত্রাণের টোকেনের জন্য প্রতি জনের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে আদায় করছেন। টাকা না দিলে টোকেন দেওয়া হচ্ছে না। ’ এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলতাফ হোসেন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার বিনা মূল্যে চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করছে। তারা যদি টাকার বিনিময়ে চাল বিতরণ করে বিষয়টি দেখে ব্যবস্থা নিব। ’

সিলেটের বন্যাকবলিত উপজেলাগুলো হচ্ছে গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। নতুন করে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে জকিগঞ্জ উপজেলায়।

সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার জানান, ‘গোলাপগঞ্জ উপজেলা ছাড়া বাকি আটটি উপজেলায়ই বেশির ভাগ এলাকা বন্যাকবলিত। ’ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন জাহান ফাতেমা বলেন, ‘বর্ষণ অব্যাহত থাকলে রাতের মধ্যেই উপজেলা সদর বন্যাকবলিত হয়ে যাবে। ’ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহম্মদ আবুল লাইছ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বন্যা মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। ’

মৌলভীবাজার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী জানান, জেলাজুড়ে ৭৭টি চিকিত্সক দল কাজ করছে।

মৌলভীবাজারে গত সোমবার পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থাকলেও আজ তা বেড়ে হয়েছে ৩৩টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাকবলিতরা প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ পাচ্ছে কম। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, হাকালুকি হাওরের ২০০ পরিবারকে নেৌকাযোগে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আজ কুলাউড়া ব্রাহ্মণবাজার ও ভূকশিমইল ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন।

কুড়িগ্রামের প্রধান-প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে দ্বীপচর ও নদ-নদী তীরবর্তী এলাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নদ-নদীর ভাঙন। উপজেলার হলোখানা, ভোগডাঙা, যাত্রাপুর, ঘোগাদহ, মোঘলবাসা, নাগেশ্বরীর নুনখাওয়া, বামনডাঙ্গা, কালীগঞ্জ, উলিপুরের হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, চিলমারীর অষ্টমীর চর, নয়ারহাটসহ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বীজতলা ও পাটক্ষেত জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এলাকায় বসবাসরত মানুষজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। পানির চাপ বাড়লেই বাঁধের ওই অংশগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় তিস্তা নদীর ঢল ও বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকার বরাদ্দ মজুদ রাখা হয়েছে। আপদকালীন এ বরাদ্দ প্রয়োজনমাফিক দ্রুততম সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সূত্র জানায়, গত শনিবার সকালে তিস্তা সেচ প্রকল্পের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপত্সীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হছে।

সোনাগাজীতে স্লুইস গেট পানিতে বিলীন হয়েছে। গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে উপকূলীয় এলাকার অনেক স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অতিরিক্ত পানির চাপে উপজেলার চরচান্দিয়া ও চরদরবেশ ইউপির সীমানায় বেড়িবাঁধের ওপর স্লুইস গেট সোমবার বিকেলে বিলীন হয়ে যায়। ফলে তলিয়ে যাওয়া পাঁচটি গ্রামের মানুষ উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশে লাকড়ি কুড়ানোর সময় শঙ্খ নদীর স্ত্রোতে এক নারী ভেসে গেছে। তাঁর নাম আলমাস খাতুন (৩৫)। আজ সকালে উপজেলার ধোপাছড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, ধোপাছড়ি ইউনিয়নের ক্যাম্প পাড়ার বাসিন্দা ফজলুল হক পুতুলের স্ত্রী আলমাস খাতুন বাড়ির কাছে শঙ্খ নদীর কূলে দাঁড়িয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা লাকড়ি কুড়াচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ পা পিছলে তিনি নদীতে পড়ে গেলে স্রোতের সঙ্গে ভেসে যায়।

চকরিয়া ও পেকুয়ায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দুই উপজেলার দুই শতাধিক গ্রামের অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দুই উপজেলার সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়েছে।

মাতামুহুরী নদীতে তীব্র বেগে নেমে আসার পাহাড়ি ঢলের পানিতে বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি নদীতে ভেসে গেছে।
চিরিঙ্গা-কাকারা-মাঝেরফাঁড়ি সড়কের প্রপার কাকারা পয়েন্টের সড়কের বিশাল অংশ নদীতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আজ বিকেল পর্যন্ত অন্তত ১৫টি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

বান্দরবান পৌর এলাকা, লামা ও আলীকদম উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বান্দরবান পৌর শহর লামা এবং এর আশপাশের কয়েকটি গ্রাম তিন ফুট পানির নিচে রয়েছে। লামা থানা ভবনের নিচতলার বেশির ভাগ পানির নিচে রয়েছে। চিরিঙ্গ্যা-লামা সড়কের কয়েক স্থানে পানি উঠে যাওয়ায় সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে লামা ও আলীকদম উপজেলার সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আজ বিকেলে লামার স্থানীয় প্রশাসন বন্যার্তদের জন্যে ইতিমধ্যে চারটি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দিয়েছে। সেখানে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।