বন্যা বেড়েছে সিলেট ও মৌলভীবাজারে

SHARE

টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও মৌলভীবাজারের ১০ উপজেলায় বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে সিলেটে ১৭৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মৌলভীবাজারে ১৮৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে জানা গেছে।

দুই জেলার হাজার হাজার বাড়িঘর, দোকানপাট, রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে বহু ফসলি জমি। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকে এখন আশ্রয়কেন্দ্রে। বন্যাদুর্গত এলাকায় সরকারি ত্রাণ ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। তবে প্রশাসন বলছে, বন্যার্তদের জন্য যে পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন, সে পরিমাণ ত্রাণই বরাদ্দ দেওয়া হবে। অন্যদিকে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

আমাদের সিলেট অফিস জানায়, জেলার ছয় উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ। গতকাল রবিবার বন্যাকবলিত ছয় উপজেলার ১৭৪টি স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। জেলার ৯টি উপজেলায় বন্যা চলছে দুই সপ্তাহ ধরে।

কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো নিম্নাঞ্চলে পানি রয়েছে। একই অবস্থা সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতেও। তবে জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ—এই ছয় উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃষ্টিপাত কমলেও পাহাড়ি ঢলে এসব উপজেলায় প্রতিদিন পানি বাড়ছে। এসব উপজেলায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হলেও বাস্তবে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। বন্যাকবলিত এলাকায় ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার সদরে সড়কে চলছে নৌকা। বাজারের ব্যবসায়ী লিটন মিয়া জানান, ২০ দিন ধরে তাঁর দোকানে পানি জমে আছে। এ ছাড়া বাজারের বেশির ভাগ দোকান ও রাস্তা ডুবে যাওয়ায় ক্রেতারাও বাজারে আসতে পারছে না। এতে তাঁরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম মুরাদ জানান, তাঁর ইউনিয়নে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের বন্যার্তদের মধ্যে কিছু ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেন তিনি।

বালাগঞ্জ উপজেলায় গতকালও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক দিনের বন্যায় উপজেলা পরিষদ, হাসপাতাল ও বাজার জলমগ্ন হয়ে আছে। বন্যার কারণে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য অনেক রোগী হাসপাতালে আসতে পারছে না। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘রাস্তাঘাট বন্যায় ডুবে যাওয়ায় অনেকে আসতে পারছেন না। তবে আমরা যথাসম্ভব চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ’ বন্যাকবলিত এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছি। তবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমাদের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে নতুন চাহিদার কথা জানিয়েছি ঊর্ধ্বতনদের। ’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ সিংহ বলেন, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া ১২ মেট্রিক টন চাল গতকাল থেকে বন্যাকবলিতদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে।

ওসমানীনগর উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পানি না বাড়লেও হাওরের পানি বাড়ায় কিছু কিছু এলাকা নতুন করে বন্যাকবলিত হচ্ছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি ঘটেছে গতকালের বৃষ্টিতে। স্থানীয় সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলতাফ হোসেন জানান, বন্যার্তদের জন্য গতকাল ১৮ মেট্রিক টন চাল এসে পৌঁছেছে। আজ থেকেই ত্রাণ বিতরণ শুরু হবে।

বিয়ানীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে প্রধান ও আঞ্চলিক সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হচ্ছে। উপজেলার প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. আসাদুজ্জামান জানান, গতকাল উপজেলার মোল্লাপুর, শেওলা এবং দুবাগ ইউনিয়নে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

জকিগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাখরশাল কুশিয়ারা ডাইকে ভাঙনের কারণে উপজেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে গেছে। এসব এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, জেলার নদ-নদীগুলোর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার জানান, বিদ্যালয়ে পানি উঠে যাওয়ায় ১৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৩টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৮৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত প্রতিটি উপজেলায় মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে ছয়টি উপজেলা বন্যাকবলিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ১২৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ প্রায় তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। বন্যার্তদের জন্য যে পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন, সে পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হবে।

মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জেলার বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে মাছের ক্ষতি এবং বোরো ফসল হারিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে বন্যাদুর্গতরা। ২০০৪ সালের পর এবারই বন্যা এত বেশি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠে পড়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে বহু মানুষ। সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এবং কাগাবলা ইউনিয়নের কিছু অংশের বাড়িঘর ও ফসলিজমি হাইল হাওরের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে হাওর এলাকায় আবার পানি বেড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা তৃতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়েছে। জুড়ী, বড়লেখা, কুলাউড়া, রাজনগর ও সদর উপজেলার প্রায় ৩০টি ইউনিয়নের তিন লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। এর আগে জেলার হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওর এলাকায় দুই দফা বন্যা হয়েছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় ঘরবাড়ি ছেড়ে জেলার চারটি উপজেলার ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

কুলাউড়া-জুড়ী সড়কের কয়েকটি স্থান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বড়লেখার সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জুড়ী উপজেলা শহরের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদে আসা-যাওয়ার একমাত্র বাহন এখন নৌকা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল আলিম কালের কণ্ঠকে জানান, বন্যায় পানি ঢুকে যাওয়ায় জেলার ছয় উপজেলায় ১৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে বড়লেখায় ৬০টি, কুলাউড়ায় ৪৪টি, জুড়ীতে ২০টি, রাজনগরে ১৪টি ও মৌলভীবাজারে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ জানান, বন্যার কারণে তিন উপজেলায় ৪১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বড়লেখায় ২০টি, কুলাউড়ায় আটটি ও জুড়ীতে ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বন্ধ রাখা এ বিদ্যালয়গুলোর কয়েকটিতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, হাকালুকি হাওরের পানি কুশিয়ারা নদী দিয়ে নেমে যায়। কিন্তু বর্তমানে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যে কারণে হাকালুকি হাওরের পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে না পেরে উজানে বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলায় সর্বশেষ ২৯৪ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ৫৯ হাজার ২০০ ভিজিএফ কার্ডের অনুকূলে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তিন ধাপে ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছাড়াও তিন মাসের জন্য পাঁচ হাজার ভিজিএফ কার্ডের অনুকূলে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল এবং ৫০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল রবিবার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছে কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের একটি দল। এ দলের নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, হুইপ মো. শাহাব উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক চিফ হুইপ মো. আব্দুল শহীদ, সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ, মৌলভীবাজারের পৌর মেয়র মো. ফজলুর রহমান, জেলা যুবলীগ সভাপতি নাহিদ আহমদ প্রমুখ।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারতে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ঢলে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশে গত ৪৮ ঘণ্টায় পানিপ্রবাহ কয়েক দফা ওঠানামা করছে। গতকাল দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকার একটি বাঁধের দুটি অংশ ভেঙে যাওয়ায় গত শনিবার থেকে ওই এলাকার অন্তত ৩০০ পরিবার পানিবন্দি আছেন।

হাতীবান্ধা উপজেলা ত্রাণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফেরদৌস আলম জানান, পানিবন্দি লোকজনের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ বরাদ্দ চেয়ে জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

রংপুর অফিস জানায়, ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। গতকাল দুপুরে তিস্তা ব্যারাজে নদীর পানি বিপত্সীমার (৫২ দশমিক ৪০ মিটার) ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ভারত গজলডোবা ব্যারাজের বেশির ভাগ গেট খুলে দেওয়ায় তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সব জলকপাট (৪৪টি) খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে নদীর ভাটিতে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া রংপুরের গঙ্গাচড়ায় একটি প্রান্তিক বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে।