ছুটির ফাঁদে হাসপাতাল লাখো রোগী উৎকণ্ঠায়

SHARE

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ থেকে ২৮ জুন টানা ছয় দিনের ছুটিতে উচ্ছ্বসিত মানুষ। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেই খুশি নিয়ে আসে ঈদ।

তবে এমন আনন্দের বাইরে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণাকাতর বিপুলসংখ্যক মানুষ থেকে যাচ্ছে ঈদের দিনটিতেও। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলে প্রতিদিন ভর্তি হয়ে থাকে এক লাখের বেশি রোগী। ঈদের সময় তাদের কাছে আনন্দের পরিবর্তে ভর করে উৎকণ্ঠা। দীর্ঘ ছুটির ফাঁদে পড়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত থাকার উদ্বেগ ঘিরে রাখে তাদের; যদিও আজ শনিবার হাসপাতাল খোলা থাকবে, তবে গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই হাসপাতালে শুরু হয়ে গেছে ছুটির আমেজ। জরুরি বিভাগ ছাড়া আউটডোর যেমন বন্ধ থাকছে, তেমনি ইনডোরেও বেশির ভাগ চিকিৎসক ছেড়ে গেছেন হাসপাতাল। ফলে জরুরি বিভাগে জরুরি সেবাটুকু পেয়ে যারা ইনডোরে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হচ্ছে, তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য থাকছেন মধ্যম বা জুনিয়র পর্যায়ের ‘ডিউটি’ ডাক্তাররা। এমনকি ভর্তির দিনেও কোনো কোনো হাসপাতালে ‘বড়’ ডাক্তারদের নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে রোগীর জন্য।

রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভেতর থেকে এক রোগীকে ধরাধরি করে বের করে আনছিল স্বজনরা। রোগীকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে আশফাক নামের এক স্বজন বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে নাকি ঠিকমতো ডাক্তার পাওয়া যাইব না, তেমন একটা চিকিৎসা অইব না। তাই আমগো রোগীরে বাড়িত লইয়া যাই। ঈদের পরে আবার আইন্যা ভর্তি করাইমুনে। ’

মাদারীপুরের সোলায়মান সরদারের বৃদ্ধ বাবা পুকুরে গোসল করতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে কোমরের জয়েন্ট বা জোড়া ছুটে গেছে, ভেঙে গেছে একটি হাত। গত বুধবার তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন অপারেশন করতে হবে। তবে এ জন্য অনেক দিন থাকতে হবে এ হাসপাতালে। সোলায়মান বলেন, ‘ঈদের পর ছাড়া নাকি অপারেশন করা যাবে না—চিকিৎসকরা এমনটাই জানিয়েছেন। তাই আমাদের পরিবারে এবার আর ঈদের আনন্দ বলে কিছু নেই। বাবাকে এ অবস্থায় হাসপাতালে ফেলে রেখে আমাদের কি ঈদ হয়! বরং ঈদের ছুটির কয়েক দিন চিকিৎসা কী হয় না হয় সেই টেনশনেই আছি। আপনারা শুধু দোয়া করেন। ’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের ছুটির কারণে রোগীদের উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার কিছু নেই। সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে সচল থাকবে। চিকিৎসকরা যাতে রোটেশন রোস্টার অনুসারে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন সে জন্য সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। জরুরি বিভাগ ও ইনডোরে যেমন ঈদের ছুটির মধ্যে চিকিৎসা চলবে, তেমনি আউটডোরও ঈদের পরদিন সীমিত আকারে খোলা রাখার জন্য এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা আবার বিশেষ টিমের মাধ্যমে মনিটর করা হবে।

জ্বরের সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, খিঁচুনি আর মুখ দিয়ে লালা বের হওয়ায় চার বছরের শিশু শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত মা-বাবা গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ছুটে আসেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। জরুরি বিভাগ থেকে তাকে যথারীতি ভর্তি করা হয় কেবিনে। আবাসিক চিকিৎসক তাকে দেখে তাৎক্ষণিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন এবং প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। এর প্রায় ২০ ঘণ্টা পর ওই রোগীকে দেখতে আসেন সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের একজন চিকিৎসক। তা-ও ওই হাসপাতালের পরিচালকের হস্তক্ষেপে।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় জরুরি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক-কর্মচারীরা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছেন। আছে রোগীদের ভিড়ও। কেবিন ব্লকে কর্মরত একজন নার্স বলেন, ‘শুক্রবার তো এমনিতেই কোনো বড় কোনো ডাক্তার আসেন না, ডিউটি ডাক্তারের সংখ্যাও থাকে কম। এর ওপর এবার ঈদের কারণে অনেকেই ছুটিতে চলে গেছেন। তবে আজ (শুক্রবার) হঠাৎ করেই কেবিনের এক শিশুকে দেখতে এসেছিলেন একজন সহকারী অধ্যাপক। শুনেছি, রোগীর লোকজন পরিচালক স্যারকে বারবার অনুরোধ করার পর ওই চিকিৎসক এসেছিলেন। তবে কাল শনিবার বিভাগীয় প্রধান ডা. সেলিমুজ্জামানসহ অন্য সবাই আসতে পারেন। ’

রোগী শ্রেষ্ঠার বাবা বলেন, ‘ভাগ্য ভালো যে এ হাসপাতালের পরিচালক সাহেবের হস্তক্ষেপে ২০ ঘণ্টা পরে হলেও চিকিৎসকের দেখা পেলাম। নয়তো শনিবারের আগে নাকি কোনো চিকিৎসকই আসতেন না। মাঝের সময়টা আমরা খুবই উদ্বেগে ছিলাম, স্বস্তি পাচ্ছিলাম না, ভয় হচ্ছিল আমার সন্তানের পরিণতি নিয়ে। কারণ কিছুক্ষণ আগেই অন্য এক কেবিনে এক নবজাতকের মৃত্যুর খবর শুনেছি। ’

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুক্রবার সাধারণত প্রফেসর লেভেলের কেউ হাসপাতালে আসেন না খুব মারাত্মক কোনো রোগী না থাকলে। ডিউটি ডাক্তাররাই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। যদি তাঁরা সামাল দিতে না পারেন, তবে সিনিয়রদের কল করেন। তবে প্রয়োজন হলে অন কলে থাকা যেকোনো চিকিৎসকই ছুটে আসেন। ’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন রুখসানা আক্তার বলেন, ‘আমার রোগীর পিত্তে পাথরের অপারেশনের জন্য দুই সপ্তাহ আগে এখানে ভর্তি করাই। এর মধ্যে এক দফা তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। এখন আবার বলা হয়েছে ঈদের পর ছাড়া নতুন শিডিউল দেওয়া যাবে না। ঈদের সময়ে ডাক্তাররাও নাকি ছুটিতে থাকবেন। তাই খুবই দুশ্চিন্তায় আছি, যদি আমার রোগীর কিছু হয়ে যায়!’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান জানান, সাধারণত ঈদের ছুটিতে রুটিন অপারেশন থাকে না। তবে অন্য সব সেবা ঠিকমতোই চলবে। রোটেশনের ভিত্তিতে সব বিভাগেই চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করবেন। এমনকি বহির্বিভাগের রোগীদের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থায় ঈদের বন্ধের মাঝে আগামী ২৮ জুন বুধবার বহির্বিভাগ খোলা থাকবে। তবে ওই দিন অফিস বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৫, ২৬ ও ২৭ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও অফিস বন্ধ থাকবে; যদিও ওই তিন দিন জরুরি বিভাগগুলো ও হাসপাতালের ইনডোর সেবা প্রচলিত নিয়মে যথারীতি চালু থাকবে। পাশাপাশি ঈদের ছুটির মাঝে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয় সে জন্য মনিটরিং টিম কাজ করবে।

এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এক সার্কুলারের মাধ্যমে দেশের সব সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঈদের পরদিন সব হাসপাতালের আউটডোর খোলা রাখার জন্য। সেই সঙ্গে পুরো ছুটির মধ্যেই সব হাসপাতালে জরুরি বিভাগ স্বাভাবিকভাবে চালু রাখতে বলা হয়েছে। গত ২১ জুন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দিলসাদ বেগমের সই করা ওই সার্কুলারে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনার পর ২২ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) শ্যামল কান্তি সরকার জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ক্লিনিকেও ঈদের পর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সব আউটডোর খোলা রেখে রোগীদের সেবা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে দেশে সরকারি ৬১০টি এবং বেসরকারি চার হাজার ৫৯৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে মোট শয্যাসংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার ৩৬০। এর মধ্যে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড বা শয্যা খালি থাকে। অন্যদিকে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে বেডের তুলনায় গড়ে দেড় থেকে দুই গুণ রোগী থাকে। ফলে এসব যোগ-বিয়োগ সাপেক্ষে প্রতিদিন দেশের সব হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা এক থেকে সোয়া লাখের মধ্যে থাকে। ঈদের সময় অনেক রোগী বাড়িতে ঈদ করার জন্য স্বেচ্ছায় হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও প্রায় এক লাখ রোগী থেকে যায় হাসপাতালে। এ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে থাকা রোগীদের জন্য ঈদের দিন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।