লিজ বাণিজ্যে ডুবছে বিমান

SHARE

উড়োজাহাজ লিজ বাণিজ্যে ডুবছে বিমান। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থাটিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে এ বাণিজ্য। লিজের যৌক্তিকতা প্রমাণে সংস্থাটি নিজস্ব বেশ ক’টি এয়ারক্রাফট পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে রেখেছে।

বহরের নিজস্ব উড়োজাহাজ বসিয়ে রেখে ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজ চালানো হচ্ছে। এতে বিমানের আয় কমে দিন দিন ব্যয় বাড়ছে। পাশাপাশি প্রতিদিন সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। এবারও হজের জন্য এয়ারবাস লিজ নেয়ার পাঁয়তারা চলছে।

লুটপাটের মাধ্যমে নিজদের আখের গোছাতে ব্যস্ত একটি সিন্ডিকেট পেছন থেকে এসব করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ভুল চুক্তির কারণে মিসরের ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের একটি এয়ারক্রাফট ও একটি ইঞ্জিন না চালিয়েও ভাড়া ১৬৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ দিতে হবে লিজদাতাকে।

এর আগে নাইজেরিয়ার কাবো নামের একটি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ লিজ নিয়ে বিমানকে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ গুনতে হয়েছিল।

এয়ার আটলান্টা নামের একটি এয়ার সংস্থার কাছ থেকে বিমান লিজ নিয়ে এক বছরে ৫৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থ লোকসান দিতে হয়েছে।

পর্তুগালের ইউরোআটলান্টা নামের অপর একটি লিজ উড়োজাহাজের জন্য বিমানের ২২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

মঙ্গোলিয়া থেকে বোয়িং ৭৬৭ উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার জন্য বিমান পরপর ২ বছর নিজের নতুন বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে।

এতে ৬০ কোটি টাকা লাভ হলেও নতুন জাহাজগুলোর সাইকেল, সৌন্দর্য ও মেরামতের পেছনে খরচ হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ। এভাবে প্রতিটি উড়োজাহাজ লিজের সঙ্গে বিমানের বড় ধরনের ক্ষতি জড়িয়ে আছে।

এরপরও থামছে না লিজ বাণিজ্য। অভিযোগ আছে, খোদ ফাইন্যান্স বিভাগের একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে এ লিজদাতাদের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা। মূলত মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে এ বিভাগের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তা প্রতি বছর বিমানের বারোটা বাজাচ্ছেন। এর সঙ্গে বিমানের প্রকৌশল, পরিকল্পনা ও ফ্লাইট অপারেশন শাখার দুর্নীতিবাজ বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা জড়িত।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের সঙ্গে বিমানের লিজ চুক্তি নিয়ে তারা খুবই অস্বস্থিতে আছেন। এজন্য বিমানকে বড় অংকের মাশুল গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ নিয়ে ইতিমধ্যে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে লিজ নিয়ে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়েছে কিনা প্রয়োজনে তাও তদন্ত করে দেখবে এ তদন্ত কমিটি। এরপর রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

২০১৪ সালে সম্পাদিত ৫ বছর মেয়াদি একটি লিজ চুক্তি এখন বিমানের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে। এ চুক্তির কারণে বিমানকে একটি এয়ারক্রাফট ও একটি ইঞ্জিন না চালিয়েও ভাড়া হিসেবে ১৬৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ দিতে হবে লিজদাতাকে। ওই এয়ারক্রাফটের লিজদাতা মিসর ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স জানিয়ে দিয়েছে ভাড়া পরিশোধের পাশাপাশি মেয়াদ শেষে তাদের উড়োজাহাজটি আগের অবস্থায় (ভাড়া নেয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল) ফিরিয়ে দিতে হবে। এতে নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে ও মেরামত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আরও ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৮৮ কোটি টাকা) গুনতে হবে।

এ উড়োজাহাজ লিজের সময় স্থানীয় একটি কোম্পানিকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় এজেন্টের সব কাজ করছে বিমান। অথচ বিমানের ফাইন্যান্স বিভাগের ওই সিন্ডিকেট ভাড়ার টাকার ৫ শতাংশ হারে স্থানীয় এজেন্টকে প্রতি মাসে দিচ্ছে প্রায় ৪৭ লাখ টাকা। বিষয়টি প্রকৌশল বিভাগ থেকে একাধিকবার বিমানের শীর্ষ ম্যানেজমেন্টকে জানালেও কোনো প্রতিকার হয়নি। অভিযোগ আছে, এ খাত থেকেও বড় অংকের মাসোয়ারা পেত ফাইন্যান্স বিভাগের সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট।

এবারও হজের জন্য লিজ নেয়া হচ্ছে একটি এয়ারবাস। অভিযোগ ওঠেছে, এ এয়ারবাসের স্থানীয় এজেন্ট বিমানের ফাইন্যান্স বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর এ কারণে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ লিজ না নিয়ে এয়ারবাস নেয়া হচ্ছে চড়া মূল্যে। এছাড়া বর্তমানে আরও দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মিসর থেকে লিজে আনা আলোচিত বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের এ এয়ারক্রাফটটি বর্তমানে নষ্ট হয়ে বিমানের হ্যাঙ্গারে পড়ে আছে।

একইভাবে পড়ে আছে ১টি অতিরিক্ত ইঞ্জিনও। ড্রাই লিজে আনা উড়োজাহাজটি বিমানবহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চে। মাত্র এক বছর ফ্লাইট পরিচালনার পরই দেখা দেয় বিপত্তি। চাঞ্চল্যকর ও বিতর্কিত এ লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষে বিমানকে এয়ারক্রাফট ভাড়া বাবদ ১৩৫ কোটি টাকা, একটি ইঞ্জিনের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার ডলার হিসাবে ৫ বছরে ২৮ কোটি টাকা আর লোকাল এজেন্টের জন্য ৫ বছর শেষে ৩ কোটিসহ মোট ১৬৬ কোটি টাকা গুনতে হবে।

লিজ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএম মোসাদ্দিক আহমেদ কিছুদিন আগে বলেছেন, ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স থেকে লিজে আনা উড়োজাহাজটি বিমানের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে।

তবে সব লিজকে ঢালাওভাবে খারাপ বলা যাবে না। কারণ সংস্থার প্রয়োজনে ও সিডিউল ঠিক রাখতেই উড়োজাহাজ লিজ নিতে হয়। অন্য কোনো কারণে নয়। তিনি বলেন, কাবো, ইউরোআটলান্টা ও এয়ার আটলান্টার লিজ তার আমলে হয়নি।

তার মতে ইজিপ্ট থেকে নেয়া উড়োজাহাজটিতে ঝামেলা দেখা দেয় ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার পর। ২০১১ সালে বিমান একটি বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজ লিজ নিয়েছিল এয়ার আটলান্টা নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে।

ওই লিজে বিমান ৫৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। লোকসানের কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল বিমানের পরিকল্পনা ও ফাইন্যান্স বিভাগ লিজ নেয়ার সময় উড়োজাহাজের গড় কেবিন ফ্যাক্টর ৮০ ভাগের ওপর ধরে হিসাব চূড়ান্ত করেছিল।

কিন্তু চুক্তি শেষে দেখা গেছে, লিজে আনা বোয়িং ৭৪৭-এর কেবিন ফ্যাক্টর ছিল মাত্র ৬৮.৪০ শতাংশ। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী ওই এয়ারক্রাফট ১ বছরে ৩ হাজার ঘণ্টা আকাশে উড়ার কথা। কিন্তু বিমানের একটি সিন্ডিকেট গোপনে ম্যানেজমেন্ট ও বিমান পরিচালনা পর্সদকে না জানিয়ে চুক্তির বাইরে আরও ৪৪৯ ঘণ্টা বেশি অকাশে উড়ায়। এতে বিমানকে ৫৪ কোটি টাকার বাইরে অতিরিক্ত ২ লাখ ৭০ হাজার ৪৬০ মার্কিন ডলার বেশি গুনতে হয়েছিল।

একই অভিযোগ ছিল নাইজেরিয়ার কাবো এয়ারলাইন্স থেকে লিজে নেয়া উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৪৭-এর বিরুদ্ধে। ওই উড়োজাহাজটিও চুক্তির বাইরে বড় অংকের টাকার ফ্লাই করেছিল।

বিমান পরিচালনা পর্ষদকে না জানিয়ে তৎকালীন বিমান ম্যানেজমেন্ট গোপনে ওই ফ্লাই করে। অভিযোগ আছে হজের জন্য উড়োজাহাজ ভাড়ায় এনে বিমান ম্যানেজমেন্ট গোপনে ওই উড়জোহাজটি চুক্তির বাইরে আরও ৩ মাস বেশি চালিয়েছিল। এতে বিমানকে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ গুনতে হয়েছিল ওই বছর।

তারও আগে ফাইন্যান্স বিভাগের যোগসাজশে সিন্ডিকেট সিকিউরিটি মানি কাটছাঁট না করে লিজে আনা একটি উড়োজাহাজের ছাড়পত্র দিয়ে দেয়ায় বিমানকে ২২ কোটি টাকার বেশি অর্থ গুনতে হয়েছিল।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে উড়োজাহাজ সংকটের কথা বলে বিমান কর্তৃপক্ষ পর্তুগালের ইউরোআটলান্টা নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফট লিজ নেয়। ঘণ্টায় ৬ হাজার ৪শ’ ডলারে উড়োজাহাজটি লিজ নেয়া হয়।

কিন্তু নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এক বছরের মাথায় উড়োজাহাজটি ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিমান।