‘বউ, শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখিস!’

SHARE
রাজধানীর তুরাগের কালিয়ারটেকের একটি পরিবারের এই ট্র্যাজেডি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার রাতে। রাজধানীর ভেতরে এ সীমান্তে লাখো স্বল্প আয়ের পরিবারের বাস। সভ্যতা, আইন, নাগরিক সেবার খাটো হাত ওই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। অপঘাত, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যাবতীয় সহিংসতা অবলীলায় এসব জায়গায় হানা দেয়।

উদ্ধার হয়েছে, উদ্ধার হয়েছে, উদ্ধার হয়েছে! তিনটি মাসুম শিশু ও তাদের একটি মা উদ্ধার হয়েছে! সম্পূর্ণ নিহত অবস্থায়। এক পরিবারের চারটি লাশ উদ্ধারের সংবাদ ছাপা হয়েছে! কোথা থেকে উদ্ধার হলো? মা-কে উদ্ধার করা

রাজধানীর তুরাগের কালিয়ারটেকের একটি পরিবারের এই ট্র্যাজেডি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার রাতে। রাজধানীর ভেতরে এ সীমান্তে লাখো স্বল্প আয়ের পরিবারের বাস। সভ্যতা, আইন, নাগরিক সেবার খাটো হাত ওই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। অপঘাত, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যাবতীয় সহিংসতা অবলীলায় এসব জায়গায় হানা দেয়।

হয়েছে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায়, আর সন্তানদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের বিছানা থেকে। তাদের অপহরণ করা হয়নি, বন্দুকযুদ্ধে মারা হয়নি, নদীর তলা কিংবা ভবনধস থেকেও লাশ উদ্ধারের কষ্ট কাউকে করতে হয়নি। তারা তাদের আপন ঘরে, যা নাকি শান্তির নীড় হওয়ার কথা, সেখান থেকেই উদ্ধার হয়েছে! লাশগুলি কি কেউ চুরি করেছিল, যে উদ্ধার করতে হবে? ‘উদ্ধার’ কথাটার মধ্যে যে আশ্বাস থাকে, ‘লাশ উদ্ধারের’ বেলায় তো কোনো সুসংবাদ নেই! কোন বাস্তবতার এ কেমন শিরোনামের খবর?

স্নায়ু চিপে ধরা, মন খামচে ধরা সংবাদ আর তো নেওয়া যায় না। ক্রিকেটে আগের রাতের অবিশ্বাস্য বিজয়ের আনন্দমাখা মন নিয়ে যে সকালে ঘুম ভাংলো, সে সকালেরই সংবাদ, ‘মা ও তিন সন্তানের লাশ উদ্ধার। শিরোনামের নিচেই প্রশ্ন, ‘আত্মহত্যা না হত্যাকাণ্ড?’ মায়ের বয়স মাত্র ৩৪, শিশুদের বড়টি শান্তার বয়স ১৩, শেফা ৯ এবং আদরের খনি সাদের বয়স মাত্র ১১ মাস। পত্রিকায় তাদের হাসিখুশি যে ছবি ছাপা হয়েছে তার দিকে তাকানো যায় না। ছবির সঙ্গে হত্যার বিবরণটা পড়লে মা ও তিন শিশুর ফাঁসলাগা নিহত-নিথর মুখ মনে ভাসে। দুনিয়ার কারো শিশুর সঙ্গে এমনটা করা না হোক? আমরা আবারো ভাবি। এই কথা আমরা নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার পর ভেবেছিলাম, শিশু রাজন ও সামিউলকে পিটিয়ে হত্যার পর ভেবেছিলাম, কেরানীগঞ্জ ও বাহুবলের ঘটনার সময়ও ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে আর কিছুই ঠেকে থাকেনি। পরে আমরা ভুলে গেছি। জীবন চলেছে আগের মতোই, আগের মতোই শিশুহত্যাও হয়ে চলেছে। জীবনের পক্ষে আগাম নিশ্চয়তা আমাদের নেই।

তদন্তের আগেই সত্য জানার ভান করা উচিত না। খবরে হত্যার তিনটি মোটিভ বা মতলব অনুমান করে নেওয়া হয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী পিতা প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন, চাকরিটাও গেছে তাঁর। অভাবের গঞ্জনা আর শাশুড়ি-ননদের গঞ্জনা সইতে না পেরে তিন শিশু নিয়ে মা মানুষটি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। দ্বিতীয় অনুমান: এলাকার যে দুই প্রভাবশালীর কাছে পিতার বড় অঙ্কের পাওনা টাকা নিয়ে সমস্যা, তারাও এটা ঘটাতে পারে। তৃতীয় অনুমানে অভিযোগের আঙ্গুল স্বয়ং পিতার দিকেই যায়; বিরল হলেও এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। তবে, আলামত ও প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, পিতাটি আসলেই অসহায়, আসলেই অসহনীয় শোকের শিকার। খুনীর শোক থাকে না, পিতার থাকে।

যা-ই ঘটুক, হত্যার শাস্তি হতে হবে। সামাজিক সহিংসতা বা অপরাধমূলক হত্যার ঘটনায় ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ শুনতে চাই না। আমরা সেই কর্তৃপক্ষ চাই যে দায় নেবে, যে সমব্যথী হবে, যে বলবে ‘অনেক হয়েছে আর নয়’। কিন্তু রাজনীতির নির্দয় মানুষদের দেখে ভরসা জাগার বদলে মন দমে যায়। ওদিকে ত্বকী, সাগর-রুনী, তনু-আফসানা, রমেল চাকমাদের মৃত্যু অবিচারের রেকর্ড গড়ে।

হত্যার মহামিছিলের সামনের সারিতে শিশুদের এত লাশ আর কত সহ্য করা যায়? সবচেয়ে গভীর ও সহজাত প্রবৃত্তিতে আঘাত লাগে। ভয় ধরে যায়। মানুষের প্রথম শক্তিশালী প্রবৃত্তি হলো নিজের সুরক্ষা। তারপরে তার প্রজাতির সুরক্ষা। শিশুর মধ্যে আমরা নিজেদের এবং প্রজাতির ভবিষ্যত দেখি। শিশুরা নিরাপদ হলেই ‘নিজ’ ও ‘মানপ্রজাতি’ দুই-ই বাঁচে। শিশুকে বাঁচাব বলেই তো বড়রা, অভিভাবকেরা, পিতা-মাতারা মুক্তিযুদ্ধ থেকে জীবনযুদ্ধ লড়ে যাই। ‘যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে’ সেই শিশুরা অপহরণের শিকার হবে, মুক্তিপণ না দিলে হত্যা করা হবে, বাবা বা মাকে শাস্তি দিতে তাদের নৃশংসভাবে খুন করা হবে, ধর্ষণের বিচার না পেয়ে কন্যাকে নিয়ে দিনমজুর বাবা ট্রেনের নিচে লাফ দিয়ে জীবনজ্বালা জুড়াবে, অভাবে-অশান্তিতে মা-বাবা সন্তানসহ আত্মঘাতী হতেই থাকবে? এটা মেনে নিলে দেশটা আশার সমাধি হয়ে পড়বে। শিশু হত্যার ধরন ও কারণের ফর্দ যতই লম্বা, সত্যটা ততই সহজ ও নির্মম: হত্যার সহজ নিশানায় শিশুরা। সমাজ সমতলে জীবনবিরোধী কিছু একটা ঘটছে। এটা সুস্থ নয়, এটা বিকৃত।

গত চার বছরে হত্যা হয়েছে ১ হাজার ১৮৫ জন শিশু। এ বছরের প্রথম দেড় মাসে ৪২ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। রাষ্ট্র যত নির্দয় হচ্ছে, অর্থনীতি যত স্বার্থপর হচ্ছে, জীবনটা যত রেসের ঘোড়ার বেদম দৌড় হচ্ছে, বিচারহীনতার গ্যারান্টি যতই অপরাধীদের স্পর্ধা বাড়াচ্ছে, সমাজও হয়ে উঠছে ততটাই সহিংস-অনিরাপদ। সদরমহল থেকে আসা এত কিছুর চাপ-তাপ পরিবারের অন্দরেও চলে আসে। রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতির যাবতীয় ক্রিয়ার গ্রহীতা হলো পরিবার, যার প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা খুবই কম। পরিবার এখন এক অরক্ষিত জমি, যার বেড়া দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কী ধনী কী গরিব, পরিবারকে শান্তিতে ও নিরাপদে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দেশটা হাজারো চাপ-তাপ-ভয় উত্তেজনায় কাঁপতে থাকলে তার ঢেউ পরিবারের ওপরও আছড়ে পড়ে। আমরা দেখছি সম্পর্কের সুতা স্বার্থ আর হিংসার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। সমাজ-সম্পর্ক-পরিবার মাইনফিল্ড হয়ে উঠছে। সেই মাইনফিল্ডে পা ফেলেই চলছি আমরা। আর নিয়মিতভাবে বিষ্ফোরণ ঘটছে। সম্পর্কের বিষ্ফোরণ, ক্ষমতার দাপটের বিষ্ফোরণ, সামাজিক সুরক্ষাজাল ফেটে যাওয়ার বিষ্ফোরণ। আর কেবলই শিশুদের কেবলই শিশুদের মৃত্যু ঘটতে দিয়ে মরে যাচ্ছি আমরাও।

সিরিয় যুদ্ধে নিহত শিশুর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশে যুদ্ধ নেই বহু বছর। কিন্তু শিশুহত্যা কি থেমেছে? কবি আবুল হাসানের কথাই কি তবে সত্য হবে? ‘আমার চোয়ালে রক্ত হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম/ আমি শিশু হত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়!…আমি জানতাম হে অর্জুন/ মানুষ জন্ম চায় না, মানুষের মৃত্যুই আজ ধ্রুব!’ তারপর তিনি বলছেন, ‘আমি জানতাম/ ফুল ফুটবে না, ফুল ফুটবে না, ফুল আর ফুটবে না, ফুল আর কখনো/ ফুটবে না!’

এই রোমান্টিক দুঃখবাদ আমাদের নয়। আমাদের বাঁচতে হবে। তার জন্য নাছোড়বান্দা জেদ দরকার, সামাজিক আন্দোলন দরকার, সমস্যার শেকড় ওপড়ানো দরকার। তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। রাষ্ট্র একটা যন্ত্র হতে পারে, কিন্তু মানুষ মায়ার সন্তান, মানুষের শিশুরা মায়ার পাখী। মায়ার পাখীদের ডানা ঝাপটানো মৃত্যু দেখার দেশ বাংলাদেশ হতে পারে না। বাংলা কবিতার আদিতম একটি আকুতি ছিল এই: ‘বউ, শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখিস, আবার বৃষ্টি হবে!’

হাজার বছর আগের আকুতিটা আজো মর্মান্তিক সত্য হয়ে আছে। আর যখন কারো বউ, শিশুসহ মরে যায় তখন হতভাগ্য লোকটা কীসের আকুতি জানাবে?