১.
পাঠকের পাঠ অভ্যাসের রীতি এবং প্রত্যাশা অধুনান্তিককালে এসে প্রায়ই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। আধুনিকতার অনুশাসনে যে পাঠ পদ্ধতি এবং পাঠক গড়ে উঠেছে অধুনান্তিক রচনা (text) পাঠ করতে গিয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলছে। আধুনিকতায় (Modernity) দীক্ষিত এসব পাঠক এবং পাঠ রীতির উৎস আলোচনা না করলে আসলে এই দ্বন্দ্ব/বিপর্যয়/খেই হারিয়ে ফেলার কারণ বোঝা যাবে না ।
আধুনিকতার জ্ঞানভাষ্যে (Discourse) পাঠ পদ্ধতির দীক্ষা দেয়া হয়েছে পাঠ্যপুস্তকে প্রণয়ন এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পাঠককে শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে।
– ‘they reflect, often from a distance, what has been consciously and unconsciously thought about literature in a certain era’. Or to put it in a different image: ‘ they function as a hatch, they contain the ideas that future writers and readers will receive as frame of reference’.
মডার্ন সমালোচক, ভাবুক ও প্রশিক্ষকরা একটা ভালো কবিতাকে মনে করেছেন ‘জৈব বিশ্ব’ (A microcosm) হিসাবে যার চাবি পাঠকের হাতে এবং সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করা যাবে কবির বিশ্বে (the key of the poem as a whole), অর্থাৎ কবিতাকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে প্রাকৃতিক এবং ব্যতিক্রমী জ্ঞানের উৎস হিসাবে। ‘ভালো কবিতা’র তকমা দেয়া হয়েছে যে কবিতা সুশৃংখলভাবে জীবন্ত সত্তার (living organism) ন্যায় সুবিন্যস্ত- Ôan individual whole in which the constituent parts are related organically to each other and to the whole, to existence and life’.
– Westerlinck, Het schoone geheim, P- 211
পাঠের ক্লাসিক্যাল তত্ত্বের দ্বিতীয়টি হচ্ছে যে কোনো একটি রচনা (text) একটি বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে পাঠক শুনতে পায় খাঁটি ‘কন্ঠস্বর’ (Authentic Voice) । কবিতায় থাকে একজন বক্তা আমি (speaking ‘I’) যা নির্দেশনা দেয় পারসেপশন তৈরিতে, একজনের কন্ঠস্বর (কন্ঠস্বরটি কবির নাও হতে পারে) যা পাঠক শোনার চেষ্টা করে এবং সে কন্ঠস্বরের সাথে পাঠক যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। ধরে নেয়া হতো কবি কবিতায় উপস্থিত এবং কবির ‘ব্যক্তিগত’ অনুভূতি পাঠক অনুভব করতে পারবে বা বুঝতে পারবে । পাঠ্যপুস্তকগুলোতে কবিতাকে বিবেচনা করা হয়েছে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে (form of communication) যেখানে কবি বার্তা প্রেরক, কবিতা একটি বার্তা এবং পাঠক বার্তা গ্রাহক (`Genuine poetry can communicate before it is understood.’ – T. S. Eliot)। অর্থাৎ ÔPoetry is the transmission of meaning’.
– De Groot, Algemene versleer, P – 67
বার্তা প্রেরক (কবি বা রচয়িতা) তথ্য বা বিষয় (কবিতা বার্তা গ্রাহক (পাঠক)
Sender Message Receiver
(Archetype) (Transmission Loss) (Logo-centrism, Performance & Competence)
একটি রচনার পাঠ উদ্ধারের (Interpreting a text) ব্যবস্থাপত্রটি তাই দেয়া হতো কোন কবিতার উপাদানগুলোর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের একীভুবন। এই একতা মূলত: চাওয়া হতো কবিতার গঠনে, যে গঠনটি উপস্থাপন করতো কবি বা রচয়িতাকে । পাঠের এই ভাবতত্ত্বের বিরুদ্ধে Merlyn (১৯৬২ – ১৯৬৬) পরিচয় করান ‘New Criticism’, যার মূল স্পিরিট হলো কবি বা রচয়িতার ভূমিকা খারিজ করা।
New Criticism – is the antipersonalist conviction that a poem should not be confused with its author. কোনো কবিতা থেকে কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি (feel) বোঝা বা পাঠোদ্ধার পাঠকের জন্য দৈব বিষয় বৈকি।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত Michel Gi Waterstudies হতে ÔInclusive Reading according to Dr. Drop’ যদি আমরা নিম্নোক্তভাবে পাঠ করি, যেখানে পাঠককে কবিতা পাঠের শিল্প সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে (Didactic Monologue):
After one
reading we will
all find it
a difficult poem,
this hand o.a.
Yet we can through
patient reading
come a long way. But
in advance we must
accept that in
this kind of poem some
‘blind spots’ often
remain.
These are the places where the poet’s associations were apparently
so personal
that it is more or less a coincidence
if you can feel them still.
যেখানে মূল রচনাটি (text) ছিল নিম্নরূপ:
After one reading we will all find it a difficult poem, this hand o.a. Yet we can through patient reading come a long way. But in advance we must accept that in this kind of poem some ‘blind spots’ often remain. These are the places where the poet’s associations were apparently so personal that it is more or less a coincidence if you can feel them still.
– Drop & Steenbeck, Indringend lezen, P – 32
মডার্ন কবিতা পাঠের তৃতীয় প্রতিজ্ঞাটি হচ্ছে সঙ্গতির মূলনীতি: গঠন হচ্ছে ‘সংযোজক শক্তির জাল’ (web of cohesive forces) এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বলতে বোঝায় Ôstructural principle that unify (the) poem’ এর খোঁজ করা। প্রথমবার পড়ে কোনো রচনা (text) কঠিন মনে হলেও অধ্যবসায়ী পাঠের (Patient reading) বা পুনর্পাঠের ফলে পাঠক আরও মানে উদ্ধার করতে পারে বলে মনে করা হতো (can come a long way)। প্রতিজ্ঞাটি গড়ে উঠেছিল এই ধারণা থেকে যে কোনো একটি কবিতার সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে, প্রতিটি পাঠে ধীরে ধীরে বিভিন্ন শব্দের আন্তঃসম্পর্কগুলো উন্মোচিত হয়। অন্যকথায়, কোনো কবিতা পাঠকের কাছে নৈরাজ্যপূর্ণ মনে হলেও উচ্চস্তরে কবিতাটির অভ্যন্তরীণ সঙ্গতি থাকবে (inner coherence) এবং অর্থপূর্ণভাবে সংযুক্ত (meaningfully connected) থাকবে।
“The poem is an ‘organic’ whole, the text represents a subject, and it displays inner coherence.”
জীবনানন্দের ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’কবিতাটি সম্পর্কে নানাজনের নানা মত:
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: “কয়েকটি সর্বনাশপন্থী নারী কোথাও এক জঙ্গলের মধ্যে সদ্য জ্যোৎস্নায় নাচ শুরু করেছে। তাদের ঘিরে কয়েকটি নবীন পুরুষ। কবিতাটির ‘বিষয়’এইটুকুই- আর কিছু নেই – এখন, এরপর নানারকম তত্ত্ব – গবেষণা ও মাথার চুল ছেঁড়া যেতে পারে ।”
নরেশ গুহ: “সুনীলবাবুর ‘ব্যাখ্যা’ নিয়ে প্রধান অসুবিধে হচ্ছে এই যে, কোথায় কয়েকটি সর্বনাশপন্থী নারী এক জঙ্গলের মধ্যে সদ্যজ্যোৎস্নায় নাচ শুরু করেছে, তা আমি কবিতাটিতে খুঁজে পাচ্ছি না। আমার তো ধারণা, এটি একটি প্রগাঢ় ঠাট্টার কবিতা।”
অরুণকুমার সরকার: “প্রথম জন কবিতাটির মধ্যে মনোরম নাচের ছবি দেখতে পেয়েছেন, তার কাছে এ কবিতায় নৃত্যই প্রধান। দ্বিতীয় জনের ধারণা, ‘এটি একটি প্রগাঢ় ঠাট্টার কবিতা’। উভয়েরই মতামত আমার কাছে খুব মজাদার মনে হল । কেননা আলোচিত কবিতাটি এ-যাবৎ আমার মনে যে অর্থ বহন করে এসেছে, সেটা নাচেরও নয়, ঠাট্টারও নয়, শুনে চমকে উঠবেন না যেন, একটি পরিব্যাপ্ত বিষাদের।”
সঞ্জয় ভট্টাচার্য: “যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, শান্তি উদযাপিত করতে যুবক-যুবতীরা মিলিত হয়ে নৃত্য করছে। কবির মনে আছে ক্ষণিক শান্তি যা আরেকটি যুদ্ধের বা বিপ্লবেরিই ভূমিকা। অতীত যুদ্ধ আর ভবিষ্যৎ বিপ্লব যে শান্তির সন্ধিক্ষণে মিশেছে – জীবনানন্দ তাকেই ‘গোধূলী’ বলতে চেয়েছেন ।”
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত: “যত তাড়াতাড়ি ‘ঈশ্বরের মতো’ নারীদের ‘খোঁপার ভিতরের চুলে’ নরকের নতুন মেঘের ছবি একে দিতে পারেন, সেদিকেই যেন তাঁর দৃষ্টি। ঐশিতা আর নারকীয়তার এই সংমিশ্রণে এমন একটি জগৎ কবিতার উত্তরাংশে রচিত হলো যেখানে ক্ষমতালুব্ধ পুরুষেরা যুদ্ধ থামিয়ে দেয়, এমনকি পরিশেষে খোঁপার ওই নবজাত মেঘ ভেসে ওঠে।”
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: “দেখতে পাই অনন্ত নক্ষত্রবীথি জুড়ে এই দৃশ্যে চলছে, এই নৃত্যের হিল্লোলে কেঁপে কেঁপে উঠছে সৌর পরিবার-যে সব তারা ও নীহারিকায় মানুষের ভাগ্য জড়ানো সবই এই চঞ্চল পায়ের ভঙ্গীর নিচে কম্পমান”।
-মলয় রায় চৌধুরী
গোধূলিসন্ধির নৃত্য [সাতটি তারার তিমির]
জীবনানন্দ দাশ:
দরদালানের ভিড – পৃথিবীর শেষে
যেইখানে পড়ে আছে – শব্দহীন – ভাঙ্গা
সেইখানে উঁচু উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল – রাঙা
চুপে-চুপে ডুবে যায় – জ্যোৎস্নায়।
পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।
হরীতকী শাখাদের নিচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ
আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাস;
নৃমুণ্ডের আবছায়া – নিস্তব্ধতা
বাদামী পাতার ঘ্রাণ – মধুকুপী ঘাস।
কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো:
পুরুষ তাদের: কৃতকর্ম নবীন;
খোঁপার ভিতরে চুলে: নরকের নবজাত মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙ্কঙের তৃণ।
সেখানে গোপন জল ম্লান হয়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোন শব্দ নাই;
তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।
সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।
প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের
তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে
স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে
ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে – বরুণে
ক্রুর পথ নিয়ে যায় হরীতকী বনে – জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হয়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক – কর্কট – তুলা – মীন।।
২.
দ্যোতক
————————————————————–
ভাষা চিহ্ন = স্থাপন/প্রতিস্থাপন, সংশ্লেষণ/বিশ্লেষণ, গ্রহণ/বর্জন (Difference, Free play of language)
(যৌথ অচেতন)
————————————————————–
দ্যোতিত
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সাহিত্যকর্ম হলো একজন সৃষ্টিশীল মানুষ বা লেখকের জীবন ও জগৎ-বীক্ষণের প্রতিফলিত রূপ, যেখানে লেখকের উপস্থিতি থাকে অনিবার্যভাবে আর সাহিত্যকর্মেও মাঝ থেকে জীবন ও পরিবেশ সম্পর্কীয় প্রকৃত সত্যকে উদ্ধার করা সম্ভব। কাঠামোবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিকরা প্রচলিত এ বিশ্বাসের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বলেন, সাহিত্যকর্মে লেখকের উপস্থিতি থাকে না, লেখক তাঁর সৃষ্টির পরই মৃত এবং সাহিত্য সব সময়ই সত্যের সাথে সম্পর্কহীন। ষাটের দশকের শেষভাগে সাহিত্যতাত্ত্বিক রঁলা বার্থ কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্বেও ধারণাসমূহ তাঁর রচনার মাধ্যমে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন। বার্থের মূল বক্তব্য ছিল:
ক. একজন লেখক, ইতোমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে, এমন সব বিবরণ বা সাহিত্যকর্ম থেকে ধারণা/বর্ণনা/বক্তব্য/উপাদান ইত্যাদি নিয়ে একটি নতুন বিন্যাসে তাঁর নতুন সাহিত্যকর্মটি রচনা করেন ।
খ. লেখার মাধ্যমে একজন লেখক কোনো অবস্থাতেই নিজেকে প্রকাশ করেন না, বরং একজন লেখক তাঁর সমাজ ও সভ্যতার মাঝে অবস্থানকারী ভাষাব্যবস্থা (যা বার্থের ভাষায় always already written) থেকে উপকরণ নিয়ে কোনো বিষয়কে উপস্থাপন করেন মাত্র।
[ In ÔThe Death of the Author (1967) Roland Barthes argues that the idea of singular authorship is a recent phenomenon. Barthes explains that the death of the author shatters Modernist notions of authority and knowledge building. Barthes ends his essay by empowering the reader : “Classical criticism has never paid any attention to the reader… the writer is the only person in literature … it is necessary to overthrow the myth; the birth of the reader must be at the cost of the death of the Author.”]
মানুষের ভাষা বলা, পড়া, বোঝার যোগ্যতা (Competence) ও দক্ষতার (Performance) উপর নির্ভর করে। প্রতিটি মানুষের সমাজ, পরিবেশ ও পৃথিবী অবস্থান করে বিভিন্ন মাত্রায় । আমরা যে সমাজ ও বিশ্ব দেখি ও বুঝি, তা কিন্তু সব মানুষের জন্য এক নয় । ভাষাভিত্তিক জীবন তার নিজস্ব ভাষার গণিত ও যুক্তি দিয়ে তৈরি করে নেয় তার নিজস্ব পৃথিবীকে, নিজস্ব সমাজ ও সত্তাকে। ফলে ‘আমার পৃথিবী’, ‘তোমার পৃথিবী’ আর ‘তার পৃথিবী’ কখনো এক নয় এবং এর ফলেই আমাদের মাঝে অবস্থান করে সত্য ও মিথ্যাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম ভুল বোঝাবুঝি। ভাষা-দার্শনিক হ্বিগেনস্টাইনকে তাই বলতে হয়- ‘I am my world… The world is my world… The world is independent of my will…life is world’.
একটি লিখিত/গ্রন্থিত রচনার ব্যাখ্যা বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্লেষিত হয়ে নোয়াম চমস্কির কথিত Literary performance and competence – এর উপর নির্ভর করে, আর এ কারণেও আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্ব হয়ে ওঠে একক ও অনন্য । যদি বলি- ‘বাংলাদেশের লোকজন গড়ে ৩.৬ জন সন্তান আছে’, একজন মানুষের সন্তান ১,২,৩ বা ৯,১০ হতে পারে, কিন্তু ভগ্নাংশ (৩.৬) কীভাবে হয় তা বোঝার জন্য জানতে হবে ‘গড়’ কাকে বলে। এখানেই চলে আসে ভাষা বিষয়ক যোগ্যতা ও দক্ষতার ব্যাপার । যারা ‘গড়’ শব্দের অর্থ জানে না, তারা এই জটিল বাক্যটি থেকে কোনা অর্থই উদ্ধার করতে পারবে না। যদি ভাষার যুক্তিকে আরো একটু জটিল করা হয়- ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার… মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য’, তবে অনেকের কাছে বাক্যটি হিব্র“ বা লাতিন ভাষা থেকেও কঠিন লাগতে পারে। যাদের Literary competence আর performance ভালো তারা কিন্তু উপরোক্ত পঙ্ক্তি থেকে অর্থ খুঁজে পাবে এক নান্দনিক ব্যঞ্জনাসহ।
নোয়াম চমস্কি তাঁর তত্ত্বে বলেন যে, একজন মানুষ কোনো একটি ভাষাব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জনের পর তার অবচেতনের সংরক্ষিত ভাষাব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। প্রকাশিত ভাষার অর্থ উদ্ধারের ক্রিয়াকে চমস্কি Performance বা কৃতী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জোনাথান কালার চমস্কির এ তত্ত্বকে কাব্যবিশ্লেষণে ব্যবহার করে বলেন যে, কাব্যতত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য বা ক্রিয়া কখনও স্রষ্টা, কবি কিংবা তার সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না বরং সৃষ্টির সত্য ও অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া হয়ে উঠে কাব্যতত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য। কালারের এ মন্তব্য সৃষ্টিকে স্রষ্টার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে ফেলে আর পাঠকের যোগ্যতা (Competence) ও দক্ষতা (Performance) কে উপস্থিত করে সৃষ্টির মুখোমুখি।
ভাষাতত্ত্ববিদ সস্যুর ভাষার জৈবিক সংগঠন ল্যাগ (Langne) আর প্রায়োগিক প্রক্রিয়া উচ্চারণ (Parole) বিশ্লেষণ করে ভাষা কিভাবে অর্থ যোগান দেয় তার ব্যাখ্যা দেন। ধ্র“পদী ভাষা-দর্শন অনুসারে ভাষা হলো সময় ও সভ্যতার সাথে বেড়ে ওঠা এক বিশাল শব্দভাণ্ডার (যা সংরক্ষিত অভিধানে), যেখানে প্রতিটি শব্দ কোনো-না-কোনো বৈশ্বিক বস্তু, বিষয়, ধারনা বা সংবেদ বোঝাতে উপস্থিত। ব্যাপারটিকে একটি সাধারণ সমীকরণ দিয়ে বোঝানো যায় ঃ
ভাষা প্রতীক বা শব্দ = বস্তু বা বিষয়
সস্যুর তার ভাষাতত্ত্বে উপরোল্লিখিত সমীকরণটি সম্পূর্ণভাবে আগ্রাহ্য করেছেন, কারণ তিনি মনে করেন যে কোনো শব্দ বা ভাষাপ্রতীক প্রত্যক্ষভাবে কোনো বস্তু বা বিষয়কে উপস্থাপন করে না । একটি শব্দ/ভাষাপ্রতীক প্রকৃতপক্ষে শুধু একটি চিহ্ন হিসেবেই ভাষাব্যবস্থায় অবস্থান করে থাকে এবং ভাষা ব্যবহারের সময় একটি শব্দ উচ্চারিত কিংবা লেখা হলে এই ভাষাচিহ্ন বা শব্দ দ্যোতক(Signifier) হিসেবে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুকে দ্যোতিত (Signified) করে। একটি ভাষাচিহ্নের বিপরীতে দ্যোতক ও দ্যোতিতের অবস্থান থাকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো, যা নিম্নোক্ত সমীকরণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব ঃ
ভাষাচিহ্ন/শব্দ = দ্যোতক/দ্যোতিত
সস্যুরের তত্ত্ব অনুযায়ী ভাষাচিহ্নের বিপরীতে দ্যোতক ও দ্যোতিতের অবস্থান নির্ধারণ করা গেলেও কোনো নির্দিষ্ট বস্তু কিংবা বিষয়কে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করা যায় না এবং এর ফলে মানুষের ভাষা অবস্থান করে কোনো এক নির্দিষ্ট ভাষাব্যবস্থার আওতায় ভাষাচিহ্ন, দ্যোতক ও দ্যোতিতের ক্রিয়া-বিক্রিয়া বা সম্পর্ক হিসেবে। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারেঃ
আমরা যখন রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে লাল, সবুজ আর হলুদ রঙের আলো দেখি তখন ভাষাব্যস্থায় অবস্থানরত লাল, সবুজ ও হলুদ ভাষাচিহ্নগুলো তিনটি ভিন্নমাত্রার দ্যোতক সৃষ্টি করে দ্যোতিত হয়। লাল রঙের দ্যোতক দ্যোতিত হয়ে যে অর্থ প্রকাশ করে তা হলো ‘থামো’, সবুজের দ্যোতক দ্যোতিত হয়ে আমাদের বলে ‘যাও’ আর হলুদ ভাষাচিহ্নের দ্যোতক দ্যোতিত হয়ে আমাদের বোঝাতে চায় ‘যাবে কি যাবে না তা বোঝার জন্য অপেক্ষা করো’।
উদাহরণটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে লাল, সবুজ আর হলুদ ভাষাচিহ্নের সাথে ‘থামা’, ‘যাওয়া’ কিংবা ‘অপেক্ষা করার’ কোনো সম্পর্ক নাই, বরং প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে ভাষা চিহ্নগুলোর সময় ও অবস্থানকেন্দ্রিক দ্যোতক আর দ্যোতনার সাথে। শব্দ বা ভাষাচিহ্ন সৃষ্ট দ্যোতক/দ্যোতনা ও দ্যোতক/দ্যোতনা সৃষ্ট অর্থও সবসময় স্বেচ্ছাচারী (Arbitary)| । স্বেচ্ছাচারী বলা হয় এ কারণে যে, দেশকালমাত্রায় অবস্থান করে ভাষাচিহ্ন ‘লাল’ এর দ্যোতিত অর্থ হতে পারে যুদ্ধ, রক্ত কিংবা সিঁদুর, দ্যোতক সবুজের অর্থ হতে পারে যৌবন, শান্তি, বসন্তকাল কিংবা ফসলের ক্ষেত, আর হলুদ রঙের দ্যোতিত অর্থ নির্ধারণ করতে পারে জন্ডিস রোগাক্রান্ত সময় কিংবা চৈত্রের পুড়ে যাওয়া কোনো এক দুঃসময়কে।
আবার ধরা যাক, একজন ‘বাড়ি’ শব্দটি বিভিন্ন সময় ব্যবহার করছে। ধ্র“পদী ভাষাতত্ত্ব অনুসারে ‘বাড়ি’ শব্দের অর্থ বাসস্থান, গৃহ, নিবাস কিংবা ঘর (সংসদ বাঙালা অভিধান), কিন্তু ভদ্রলোক ‘বাড়ি’ দিয়ে পাঁচ রকম অর্থ বোঝালেন ঃ
আমি বাড়ি (বাসস্থানে) যাব ।
আমি চৌধুরীবাড়ি (চৌধুরীদের আবাসস্থানে) যাব ।
আমি রাজবাড়ি (একটা জায়গা) যাব ।
আমার মনের বাড়ি (অন্তর, মন) এখন অস্থির ।
আমার বাড়ি ফিরে যাওয়ার (মৃত্যুর) সময় হয়েছে ।
উপরিউক্ত বাক্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ‘বাড়ি’ শব্দটি পাঁচ রকম ‘দ্যোতক’ সৃষ্টি করে ‘দ্যোতিত’ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দেশ-কাল-মাত্রায়, শব্দের পরম্পরায়। বোঝা যাচ্ছে, অভিধানে লেখা ‘সরল অর্থ’ শুধু কিছু প্রাথমিক ধারণা দেয়ার জন্যই গ্রন্থিত হয়েছে, অভিধান ধুয়ে যদি কেউ আসল অর্থ উদ্ধার করতে চান, কিংবা অনুবাদ করেন, তবে তা ভাষাতাত্ত্বিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি করতে পারে।
সস্যুরের সূত্র অনুসারে ভাষাচিত্রের বিপরীতে দ্যোতক ও দ্যোতিতের অবস্থান মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো অবস্থান করলেও ভাষার অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তী পর্যায়ে আরও কিছু ক্রিয়া-বিক্রিয়া থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আর এ সম্ভাবনা অবস্থান করে দ্যোতক ও দ্যোতিতের মধ্যবর্তী স্থানে, মস্তিষ্কে ইন্দ্রিয়-কণাতরঙ্গের স্থাপন/প্রতিস্থাপন, সংশ্লেষণ/বিশ্লেষণ ও গ্রহণ/বর্জনের কোয়ান্টাম-যান্ত্রিক ক্রিয়া-বিক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। সস্যুরের সূত্র গ্রাহ্য করে তাই ভাষাচিহ্ন, দ্যোতক ও দ্যোতিতকে নিচের সমীকরণে প্রকাশ করা যায় ঃ
দ্যোতক
————————————————————–
ভাষা চিহ্ন (শব্দ) = স্থাপন/প্রতিস্থাপন, সংশ্লেষণ/বিশ্লেষণ, গ্রহণ/বর্জন
————————————————————–
দ্যোতিত
উপরিউক্ত সমীকরণ অনুসারে ভাষাচিহ্ন দ্যোতক হিসেবে মানব মস্তিষ্কে বিভিন্ন দর্শন-যান্ত্রিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটায়, যার মাঝে স্থাপন/প্রতিস্থাপন, সংশ্লেষণ/বিশ্লেষণ ও গ্রহণ/বর্জন ক্রিয়াই থাকে মুখ্য। দ্যোতকসৃষ্ট এই ইন্দ্রিয় কণাতরঙ্গ-ভিত্তিক কোয়ান্টাম-যান্ত্রিক ক্রিয়া যথাথরূপে মস্তিষ্কে পূর্ব-দ্যোতিত কিংবা পূর্ব-অঙ্কিত বিভিন্ন কণা তরঙ্গ-চিত্ররূপের সাথে স্থাপন প্রতিস্থাপন (Super imposition)সম্ভব হলেই কেবল দ্যোতক দ্যোতিত হয়ে ভাষাচিহ্নের অর্থ প্রদান করে। আমাদের মস্তিষ্কে যখন বৈশ্বিক বিষয় বা বস্তু সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয় কণাতরঙ্গ-চিত্ররূপ কোয়ান্টাম-যান্ত্রিক বিন্যাসে অবস্থান করে না, তখন সে বিষয় বস্তু বা ঘটনার ভাষাচিহ্ন শৃঙ্খলও আমাদের জন্যে হয়ে উঠে অর্থহীন এবং এ-অবস্থায় সৃষ্টি হয় অধিবিদ্যাজাত (Metaphysical) উপলব্ধির।
ধ্রপদী ধারণা অনুযায়ী ভাষা শোনা, ভাষা লেখা, ভাষা পড়া ও ভাষা দেখা এক ও অভিন্ন ভাষা ব্যবস্থার অন্তর্গত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হলেও, বাস্তবে ঘটনাগুলো ঘটে বিভিন্ন মাত্রায়। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ভাষাকেন্দ্রিক শোনা, লেখা, পড়া ও দেখার কার্য সম্পাদিত হয় মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে এবং মস্তিষ্কের সমন্বয় কেন্দ্রে এসে ভাষাকেন্দ্রিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া/স্থাপন-প্রতিস্থাপন/গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে অর্থ-উদ্ধারে সচেষ্ট হয়। ভাষাগ্রেন্দ্রিক বিভিন্ন ক্রিয়া (শোনা, পড়া, লেখা ও দেখা) যেহেতু মস্তিষ্কের বিভিন্ন অবস্থানে সম্পাদিত হয়, সেহেতু মস্তিষ্কের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহনের সময় কিংবা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মস্তিষ্কে স্থানান্তরের সময় কিছু পরিবহনচ্যুতি (Transmission Loss) ঘটতে পারে । লেখা, পড়া, দেখা ও শোনা যেহেতু অহংকেন্দ্রিক ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্ম, সেহেতু পরিবহন-বিচ্যুতির কারণে একই ভাষা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থে উপস্থিত হতে পারে।
শব্দের মাঝে মন্ত্রের গুণ আছে, শব্দকে আমরা সত্য বলে ভাবি, আমাদের যুক্তিকেও ভেঙে দিতে পারে শব্দের মোহ। আমাদের শব্দকেন্দ্রিক যুক্তির পতন সৃষ্টি করে অধিবিদ্যা। একটি রচনাকে (Text) আমরা আমাদের মতো করে পড়ে, রচনায় যা নেই তাই যোগ করে ফেলি ইচ্ছে মতো। শব্দের মাঝে এই যে ‘বিনির্মিত’ হওয়ার ক্ষমতা, একেই দার্শনিক জাক দেরিদা বলেছেন বিনির্মান (Deconstruction)। বিনির্মান কাজ করে শব্দব্রহ্মকেন্দ্রিকতা (Logocentrism), ধ্বনিকেন্দ্রিকতা (Phonocentrism) ও বিচ্ছেদের (Differance) লীলাভূমিতে। দেরিদার দর্শনের মূল উদ্দেশ্য হলো রূপান্তরহীন ধ্র“ব অর্থ (Meaning) কিংবা ধারণাকে (Concept) ভাষা চিহ্নের প্রেক্ষাপট থেকে সরিয়ে দিয়ে অধিবিদ্যার (Metaphysics) ভিতকে নাড়িয়ে দেয়া ।
সংস্কৃত শব্দ ব্রহ্ম, ল্যাটিন ও ইংরেজি শব্দের মূলে অবস্থান করে এক অপৌরুষের শব্দব্রহ্ম, যা দেরিদার দর্শনে উপস্থিত হয়েছে শব্দব্রহ্মবাদ (Logocentrism)- এর কনসেপ্ট নিয়ে। মানুষের বিবর্তনের সাথে সাথে ভাষারও বিবর্তন হয়েছে সত্য, কিন্তু এই বিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের মাঝে অবস্থান করে নিয়েছে ভাষা-সৃষ্ট কিছু চিন্তন কেন্দ্র (Centre) এবং ধ্র“ব উপস্থিতি (Presence)। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্ম, মত ও দর্শন গ্রন্থিত হয়ে প্রচারের মাহাত্ম্যে হয়ে উঠেছে দৈব অনুপ্রেরণার উৎস। কোরআন, বেদ, বাইবেল, গ্রন্থসাহেব ও অন্যান্য ঐশীগ্রন্থ, এমনকি মার্কসের এর ‘ডাস ক্যাপিটাল’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’ ইত্যাদির মতো মননশীল রচনাও আমাদের কাছে উপস্থিত হতে পারে বাচনিক শব্দব্রহ্ম (Logos) হিসেবে। আর এই শব্দব্রহ্মকেন্দ্রিক (Logocentric) চিন্তাচেতনা কোনো একটি তন্ত্র-অতিরিক্ত ‘উপস্থিতি’ (Presence) দ্বারা নির্ধারিত কোনো এক বিশেষ ‘অর্থের’ (Meaning) অস্তিত্বকে ধ্র“ব সত্য বলে মেনে নেয়, যদিও শব্দের বা ভাষাচিহ্নের নিজস্ব কোনা ‘অর্থ’ (Meaning) নেই, নেই কোন অর্থের কেন্দ্র কিংবা ধ্র“ব উপস্থিতির (Presence) চিহ্ন। ভাষার মাঝে যা আছে তা হলো এক ধরনের ‘দেশ-কাল-মাত্রা’র গতি বা মুক্ত-ক্রীড়া (Free-play) যা ভাষাচিহ্নের অর্থকে উপস্থিত করে আবার স্থগিত রাখছে অন্য আরেকটি ভাষাচিহ্নের সাথে যুক্ত হবার জন্য এবং এ প্রক্রিয়ায় একটি ভাষাচিহ্ন রেখে যাচ্ছে তার উপস্থিতির ছাপ (Trace) অন্য ভাষাচিহ্নের দ্যোতক/দ্যোতনায়, আর রেখাংকিত হচ্ছে পরবর্তী ভাষাচিহ্নের সাথে এক ধরনের দেশ-কাল-মাত্রার অর্থ জোগান দিতে।
[বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি আন্দোলনের তুলনা করতে চাইছিলেন পাঁচের দশকে ঘটে যাওয়া দুটি পাশ্চাত্য আন্দোলনের সঙ্গে । ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াংম্যান ও আমেরিকার বিট জেনারেশনের সঙ্গে। তিনটি বিভিন্ন দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তি-প্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো তাঁরা মনে করেছিলেন অভিন্ন। আমার মনে হয় বিদ্যায়তনিক ভাবনার প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে সীমিত ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞতা; অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন। যার দরুন সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে। যে-সব উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের প্রয়াস তারা করতেন না, এখনও অনেকে করেন না, যদিও হাংরি আন্দোলন নিয়ে কয়েকটি এমফিল ও পিএচডি গবেষণা হয়েছে। প্রতিস্ব-বিশেষের পাঠবস্তু কেন অমন চেহারায় গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্ব-পীড়ন ঘটাচ্ছে তার চাপে পাঠবস্তু গঠনে মনস্তাত্বিক ও ভাষানকশা কীভাবে ও কেন পাল্টাচ্ছে, আর তাদের আখ্যানঝোঁকের ফলশ্র“তিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার বদলে, তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা (ফিল গুড) নামক সাবজেকটিভ খপ্পরে পড়ে পাঠক-সাধারণকে সেই ফাঁদে টানতে চাইতেন। যে-কোনও পাঠবস্তু একটি স্থানিক কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল। কৌমনিরপেক্ষ পাঠবস্তু অসম্ভব।
কেবল উপরোক্ত দুটি পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ঘটনা নয়, ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে যে আন্দোলনগুলো ঘটেছিল, যেমন নিমসাহিত্য, শ্র“তি, শাস্ত্রবিরোধী এবং ধ্বংসকালীন, তাদের সঙ্গেও হাংরি আন্দোলনের জ্ঞান পরিমণ্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্নক্রিয়া, অভিজ্ঞতাবিন্যাস, চিন্তার আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষনী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক-নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্থাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্নাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্ক-বিন্যাসের অনুষঙ্গ, অবিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়ীতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্থানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্নায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্থনা, দেশজ-অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সূত্রায়ন-প্রকরণ, প্রোবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্ঠি পীড়াপুঞ্জ, ইত্যাদি ব্যাপারে গভীর ও অসেতধসম্ভব পার্ধক্য ছিল । ষাটের দশকের ওই চারটি আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি প্রতিসন্দভের যে মিল ছিল তা হলো এই পাঁচটি আন্দোলনই লেখক-প্রতিস্ব থেকে রোশনাইকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পাঠবস্তুর ওপর। অর্থাৎ লেখকের কেরামতি বিচার্য নয়; যা বিচার্য তা হলো পাঠবস্তুটির খুঁটিনাটি। লেখকের বদলে পাঠবস্তু যে গুরুত্বপূর্ণ, এই সনাতন ভারতীয়তা, মহাভারত ও রামায়ণ পাঠবস্তু দুটির দ্বারা প্রমাণিত ।
– “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা রচনার প্রথম শর্ত”, মলয় রায়চৌধুরী ]
দোহাই:
১. মঈন চৌধুরী , প্রবন্ধ সংগ্রহ
২. মলয় রায়চৌধুরী, ফেসবুক স্ট্যাটাস
৩. রচয়িতা বলতে কী বুঝায়, মিশেল ফুকো, ভিন্নচোখ (২০০১)
৪. Jos Joosten & Thomas Vaessens, Postmodern Poetry
Meets Modernist Discourse (2006)