টানা চার দিনের রুদ্ধশাস অভিযানের পর সোমবার বিকেলে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ এ চার জঙ্গীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আতিয়া মহলের জঙ্গী নিধন সম্ভব হয়েছে। সন্ধ্যার আগেই ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনা বাহিনীর প্যারাকমান্ডোরা। বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে সবশেষ গুলির শব্দ শোনা যায়। এর কিছু সময় আগে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তখন হয়ত আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গীরা। আতিয়া মহলের নিচ তলায় বাধাহীনভাবে সেনা সদস্যদের প্রবেশ করতে দেখা যায়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সংবাদ সম্মেলন করে অপারেশন টোয়াইলাইটের সবশেষ অবস্থা জানানো হয়। অপারেশনের দুটি পর্যায়ের একটি শেষ হলেও ভবনজুড়ে বিস্ফোরক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করেছে সেনা সদস্যরা। ভবনের সকল বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার পর পুলিশের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে। এদিকে জঙ্গীদের সকলে মারা যাওয়ায় সিলেটের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনা সদর দফতরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সংবাদ সম্মেলনে জানান, সেনাবাহিনীর অপারেশনে চার জঙ্গী নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে দুটি লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুটি লাশের শরীরের সঙ্গে আত্মঘাতী বোমা বাঁধা থাকায় তা বের করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জঙ্গীদের পরিচয় সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে চারটি লাশের মধ্যে একটি নারীর লাশ রয়েছে। তিনি জানান, পুলিশের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী চারজনের থাকার কথা ছিল। চারজনই নিহত হয়েছে। পুলিশ এদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবে বলে জানান তিনি।
ফখরুল আহসান বলেন, আমরাদের কমান্ডোরা অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গী অভিযান পরিচালনা করেছে; যা সেনাবাহিনী এবং দেশের সকলের জন্য অত্যন্ত গর্বের। তিনি জানান, এতে সেনা সদস্যদের কেউ নিহত হয়নি। তবে ভেতরে বিপুল বিস্ফোরক থাকায় সতর্ক হয়ে কাজ করতে হয়েছে। তিনি জানান, এখনও ভবনটিতে যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে তা বিস্ফোরিত হলে ভবনের এবং পাশের ভবনেরও ক্ষতি হতে পারে; এজন্য সতর্ক হয়ে কাজ করা হচ্ছে।
সন্ধ্যায় ব্রিফিংয়ে জানান, অপারেশনে চার জঙ্গী নিহত হলেও অপারেশনটি শেষ করা হচ্ছে না। এর কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। সেই প্রক্রিয়া শেষ করেই অপারেশনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ঘোষণা দেয়া হবে। তবে কখন তা করা হবে সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। তিনি বলেন, ভেতরের জঙ্গীরা ভয়ঙ্কর ছিল তারা শুধু আত্মঘাতীই নয় বেশ প্রশিক্ষিতও ছিল। এজন্য ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের সময় লেগেছে।
সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানায়, মূলত অভিযানের দুটি পর্ব ছিল। জঙ্গীদের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে যার একটি শেষ হয়েছে। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার পর দ্বিতীয় ধাপ শেষ হবে। আজ থেকে বিস্ফোরকগুলো নিষ্ক্রিয় করার কাজ শুরু হবে।
এ যাবতকালের সব থেকে বড় জঙ্গী দমনের অভিযান হচ্ছে আতিয়া মহল অপারেশন। এর আগে দেশে কোন জঙ্গী দমনে এত দীর্ঘ সময় নেয়া হয়নি। এবার এর আগে নিধনের সময় নিজেরা আত্মঘাতী হয়ে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সঙ্গে টানা চারদিন ধরে যুদ্ধ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবারই সেনাবাহিনীর সঙ্গে চারদিন ধরে যুদ্ধ করে জঙ্গীরা। তবে ভবনের পানি সরবরাহ, বিদ্যুত এবং গ্যাস লাইন আগে থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পাশাপাশি ভবনের বাইরে প্যারাকমান্ডোদের অভিযানে সোমবার সকাল থেকে জঙ্গীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিষয়টি বুঝতে পেরে সোমবার সকাল থেকে গুলি ছোড়ার পরিমাণও বাড়িয়ে দেয় কমান্ডোরা। রবিবারের তুলনায় সোমবার প্যারাকমান্ডোরা আরও আক্রমণাত্মকভাবে প্রতিরোধ করে।
পুলিশ বলছে আতিয়া মহলের কয়েক বাসিন্দার বিষয়ে সন্দেহ হলে ২৩ মার্চ রাত আড়াইটায় বাড়িটি ঘেরাও করে পুলিশ। এরমধ্যে ২৪ মার্চ সকালে আতিয়া মহল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে হাত বোমা ছুড়ে মারে জঙ্গীরা। এতে নিশ্চিত হয় আতিয়া মহলের নিচ তলায় জঙ্গী আস্তানা রয়েছে। সেখানে বাস করা আরও ২৮টি পরিবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ঢাকা থেকে জঙ্গী দমনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম সেলের সদস্যদের পাশাপাশি বিশেষ দল সোয়াট যায় আতিয়া মহলে। সেনাবাহিনী ২৪ মার্চই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ জঙ্গী হামলা হলি আর্টিজানে অপারেশন চালানো প্যারাকমান্ডো বাহিনীকে ঘটনাস্থলে ডাকা হয়। এরপরই ২৫ মার্চ জঙ্গী দমনে সেনাবাহিনীর অপারেশন টোয়াইলাইট শুরু হয়। শুরুতে বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করে ভবনটি থেকে আটকেপড়া ৭৮ জনকে নিরাপদে সরিয়ে আনে সেনাবাহিনী। বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়ার পর ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ বিকেল পর্যন্ত জঙ্গীদের সঙ্গে সেনা সদস্যদের গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সোমবার দুপুরের দিকে ভবনটির দেয়াল ভেঙ্গে সেনা সদস্যরা ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময়ও জঙ্গীদের প্রতিরোধের স্বীকার হতে হয় প্যারাকমান্ডোদের। তবে কমান্ড দল বাড়ির ভেতর প্রবেশের পর পরই ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল জানান, যে কোন মুহূর্তে শেষ হবে অপারেশন টোয়াইলাইট। তিনি এসময় জানান, মেজর জিয়ার মতো ভয়ঙ্কর কোন জঙ্গী ভেতরে থাকতে পারেন।
জঙ্গী নিধনের মধ্যে শনিবার শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ছয়জন নিহত হন। আহত হন কমপক্ষে ৫০ জন। নিহতরা হলেন পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম, আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মোঃ আবু কয়ছর, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জান্নাতুল ফাহমি, কলেজছাত্র অহিদুল ইসলাম অপু ও নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার শহীদুল ইসলাম ও ছাতকের দয়ারবাজার এলাকার কাদিম শাহ।
এদিকে সিলেটের শিববাড়ী এলাকার আতিয়া মহলে টানা ৪র্থ দিনের অপারেশনে থেমে থেমে সারা দিনই গুলির শব্দ শোনা যায়। দুপুরের দিকে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো দল ভবনের দেয়াল ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু দ্বিতীয় তলায় পৌঁছতে গেলে তাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। ভবনের নিচ তলায় জঙ্গীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিস্ফোরক রেখেছে। বোমাসদৃশ বস্তু ও ফ্রিজের কম্প্রেসার দেখতে পান কমান্ডোরা। এর মাঝেই নিজেদের কাছে থাকা বোমা ফাটায় জঙ্গীরা। বিস্ফোরণের পরপরই আতিয়া মহল থেকে কু-লী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।
বিকেলে সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সকাল থেকেই থেমে থেমে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে আতিয়া মহলে। এরমধ্যে জঙ্গীরাও বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এর মধ্যে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে তারা ভেতরে তিন-চার জঙ্গীর নড়াচড়া লক্ষ্য করেছেন। কাজেই সেনাবাহিনী মনে করছে এখনও ভেতরে প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা রয়েছেন। যাদের কাছে বোমা, গ্রেনেড ছাড়াও ক্ষুদ্রাস্ত্র রয়েছে। তিনি জানান দুপুরের পর প্যারাকমান্ডো দল ভবনের নিচের তলায় যেতে চাইলে প্রতিরোধের স্বীকার হতে হয়।
স্থানীরা বলছেন, সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। পরে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এরপর থেকে ৯টা পর্যন্ত কোন গুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে আবারও থেমে থেমে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এভাবে থেমে থেমে সারাদিনই গুলি হলেও বিকেল ৫টা ১৮ মিনিট থেকে আর গুলাগুলির কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। আশপাশের মানুষ এই নীরবতা থেকে মনে করছেন এখন অভিযান শেষের পথে। এর মধ্যে সিআইডির ক্রাইম সিন বিভাগের দুটি গাড়ি শিববাড়ী দিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
টানা চারদিনের অভিযানে আতিয়া মহল ঘিরে দেড় কিলোমিটার এলাকায় সাধারণ বাসিন্দার জীবন থমকে গেছে। এখানে প্রায় ২৫০টি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আতিয়া মহলের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু এলাকার বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন সাধারণ নামুষ। অনেকেই জীবনের ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। সোমবারও শিববাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ১৪৪ ধারা জারি হলেও এখানে মূলত কারফিউর মতো অবস্থা বিরাজ করেছে। সেখানে সারা দিন পুলিশ কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি।