কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মেলেনি ১৭ দিনেও। নানা প্রশ্নের জন্ম দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনটি জমা পড়েছিল হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিন পর, ৪ এপ্রিল।
দ্বিতীয় দফায় তিন সদস্যের একটি দল কাজ করছে। কিন্তু প্রতিবেদনের খবর নেই। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ এই প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সংশ্লিষ্ট ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিসেরা প্রতিবেদন হাতে পেলেই তাঁরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেবেন।
দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সত্যিই সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকাণ্ডের কারণ খুঁজে বের করতে পারবে কি না বা এর ভিত্তিতে তদন্ত সংস্থাগুলো কতটা কী করতে পারবে, সে নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তনুর মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
এরই মধ্যে প্রথম ময়নাতদন্তের অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অন্য খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকলে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তনু হত্যার প্রকৃত অপরাধীকে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা হলে সবার ভাবমূর্তি উন্নত হবে। কোনো জজ মিয়া নাটক বা ঘটনা ভিন্ন দিকে নেওয়া হলে তা কেউ গ্রহণ করবে না।
গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। রাত সাড়ে ১০টায় তাঁর লাশ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরে একটি জঙ্গলের মধ্যে পান বাবা ইয়ার হোসেন। ২১ মার্চ দুপুরে তনুর প্রথম ময়নাতদন্ত করেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক শারমিন সুলতানা। ওই দিন সন্ধ্যার পর কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়। রাতে এ ঘটনায় তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ভিসেরা প্রতিবেদন এলেই দ্রুত দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে নিশ্চিত করেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও তনুর লাশের ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের প্রধান চিকিৎসক কামদা প্রসাদ সাহা। গতকাল শনিবার দুপুরে তিনি তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তনুর শরীর থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সব কটি নমুনার প্রতিবেদন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে পৌঁছেনি। ওই নমুনাগুলো পৌঁছালেই প্রতিবেদন দাখিল করব। যেকোনো ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেওয়ার সময় সম্ভাব্য সকল বিষয় বিবেচনা করা হয়। আগে একটি ভিসেরা প্রতিবেদন আসতে মাস ও বছর গড়িয়ে যেত। এটার ক্ষেত্রে দেরি হবে না।’
গত ৩০ মার্চ তনুর লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সময় দাঁত, শরীর থেকে টিস্যু, স্পর্শকাতর স্থানের নমুনা নেওয়া হয়। বিভিন্ন সংস্থা নমুনা সংগ্রহ করেছে। সেসব নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই নমুনার প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত।
প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই গত ২৮ মার্চ পুলিশ কবর থেকে তনুর লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে আবেদন করে। আদালতের নির্দেশে লাশ দাফনের নয় দিন পর ৩০ মার্চ কবর থেকে তনুর লাশ তোলা হয়। ওই দিন দুপুরে তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামদা প্রসাদ সাহাকে প্রধান করে ওই বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের অপর দুই সদস্য হলেন একই কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান করুণা রানী কর্মকার ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক মো. ওমর ফারুক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিনের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কখনো কখনো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব। তবে ভিসেরা প্রতিবেদন পেতে কিছুটা সময় লাগে। ঢাকায় প্রায় এক মাস সময় লাগে।’ কুমিল্লা থেকে নমুনার ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। চট্টগ্রামে ঢাকার মতো এত ভিড় থাকার কথা নয়। তবে ওই গবেষণাগারের সক্ষমতা কতটুকু সে সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে কিছু বলা ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সারা দেশ তদন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রেক্ষাপটে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের দীর্ঘসূত্রতা তদন্তের ওপর আস্থা তৈরি করে না।
১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ৭০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ: পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. নাজমুল করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন, আমাদের প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মামলার তদন্তকাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। তনুকে হত্যা করা হয়েছে, এটা নিশ্চিত। তবে হত্যাকাণ্ডে কতজন ছিল সেটাও আমরা খতিয়ে দেখছি।’ ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত এ মামলায় অন্তত ৭০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মামলার অগ্রগতি ও ময়নাতদন্ত নিয়ে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, ‘ময়নাতদন্ত ও মামলা নিয়ে কী বলব, সবই আল্লাহ দেখছেন।’
২১ মার্চ মামলা দায়েরের পর এখন পর্যন্ত তনু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়নি। ইতিমধ্যে দুই দফা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বিভাগ পরিবর্তন করা হয়েছে।