তনুকে কেউ খুন করেনি!

SHARE

1f0a432e890f2892505ec1f885ec98e5-43মুখে কথা আসছে না। কথা বলারও একটা যোগ্যতা লাগে। সে যোগ্যতাও আমার নেই। আমাদের কারো নেই। এতদিন যে মেয়েটার খুন-ধর্ষণের বিচারের দাবিতে এত আন্দোলন হলো, মিছিল-মিটিং হলো, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী দলবেঁধে নেমে এলো পথে, স্লোগান হলো, লাঠিমিছিল হলো, তার সবই যেন গেল জলাঞ্জলি। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এসেছে তনু ধর্ষিত হয়নি! এমনকি বলা হলো, একজন মানুষ খুন হয়ে যাওয়ার জন্য যেমন গুরুতর আঘাত হওয়া জরুরি, তার নমুনাও তনুর দেহে পাওয়া যায়নি। অথচ এদিকে দেশে বিচারের দাবিতে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রায় পনেরো-কুড়ি দিন হয়ে গেল সংবাদপত্রে, অনলাইন মিডিয়ায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়ে আসছিল যে ঘটনাটি, তার কোনো আলামতই খুঁজে পাওয়া গেল না।

এমনকি ভিসেরা পরীক্ষায় কোনো বিষক্রিয়ার উপস্থিতিও পাওয়া যায়নি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। পত্রিকা মারফত জানলাম, ডা. সাহা জানান, তনুর মরদেহের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি এবং ভিসেরা পরীক্ষায় কোনো বিষক্রিয়ার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি।

এক অর্থে ভালোই হয়েছে। দেশের হিসাবের খাতা থেকে একটা অন্তত ধর্ষণের নাম কাটা গেল। তনু যদি এমনি এমনি, স্বেচ্ছায় বা অন্য কারো ইচ্ছায় নয় (যেহেতু কোনো বড় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি), বরং নিজে নিজেই মারা গিয়ে থাকে, তবে ব্যাপারটা খুনও হলো না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে বা প্রশ্নের মুখে পড়া ইমেজ রক্ষায় এটা বিরাট ভূমিকা রাখবে।

তনু ধর্ষিত হয়নি, অথচ সবাই মিলে তার জন্য চেঁচিয়ে গলা ফাটাল, অল্পবয়স্ক স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিপড়ুয়া ছেলেমেয়ে হৈহৈ করে মাঠে নেমে এলো, ব্যানার-ফেস্টুন বানাল, রাস্তা আটকাল, মানববন্ধন করল—চারদিকে আওয়াজ উঠল একটাই, তনু হত্যার বিচার চাই। সে বিচারও আর খুব বেশি চাইতে হলো না। যেহেতু ধর্ষিত হয়নি, আবার খুন হয়েছে তেমন জোরালো আলামতও পাওয়া যায়নি, সুতরাং কিসের বিচার? কার বিরুদ্ধে বিচার? বিচার হবে না। বিচার দরকার নেই। বিচার হওয়া তো দূরের কথা, বিচার চাওয়াও এ ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বলা চলে!

আর তনু, তোকেও বলি শোন, মরেছিস তো, তবু ধর্ষিত হসনি, এই আনন্দের সংবাদ তুই জেনে রাখ। তোর ছিঁড়ে ফেলা চুল, স্পর্শকাতর স্থানের আঘাত, থেঁতলানো মাথা—এসব তোর বেখেয়াল মনের কল্পনা। আরে গাধা মেয়ে, তোকে মারবেটা কে? এই দেশে তোর মতো মেয়ের গায়ে হাত তোলার লোক একটাও দেখাতে পারবি? নারীর জন্য এর চেয়ে নিরাপদ স্থান আর কোথায়? তার পরও বাইরে, রাস্তাঘাটে হলে হয়। এ একেবারে সাক্ষাৎ ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। ক্যান্টনমেন্টের ওপর দিয়ে কাকপক্ষী ওড়ার আগেও তিনবার ভেবে নেয়। আর তোকে কেউ সেখানে ধর্ষণ করবে? মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলবে? মাথায় আঘাত করে থেঁতলে ফেলবে? এত বড় দুঃসাহস কার? এসব কিচ্ছু হয়নি, বলছি তোকে শোন। এইসব তোর মনের বুজরকি।

অথবা এমনও হতে পারে, তুই মারাও যাসনি। সবার অলক্ষ্যে চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথাও পালিয়ে গেছিস। যে লাশ পাওয়া গেছে, তা তোর নয়। কোনো এক ভৌতিক রহস্যের এ লাশ। সে লাশ নিয়ে এই যে উত্তাল হলো দেশ, তাও বাস্তবিক কিছু নয় আসলে। সবটাই কল্পনা। সবটাই মিথ। যে তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ায় পড়ত, যে তনু থিয়েটার করত, যে টিউশনি করত ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে, সে হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সে এক রূপকথার গল্প। তার জন্য আবার বিচার কিসের?

তনু, তুই বেঁচে আছিস নাকি মরে গেছিস, সেই প্রশ্নের জবাবও এখানে মিলবে না। এখানে আমাদের যেমনে নাচাও তেমনে নাচি দশা! যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান! হুকুমের বাইরে যায় কী করে সব, তুই বল? তা ছাড়া এ দেশের একটা মানসম্মান আছে। ভাবমূর্তি আছে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ধর্ষিত হয়েছে, খুন হয়েছে—এসব জানাজানি হলে ইজ্জত থাকে না! ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এখন তোর একজনের জন্য এত বড় ইজ্জতের বারোটা বাজানো কি ঠিক হবে? তুই বল? একটু বিচার-বিবেচনা করে বল তুই? জানি তুই ধর্ষিত হসনি, এ কথা হাসিমুখেই মেনে নেব। অন্তত অতটুকু বড় প্রাণ তোর ছিল। না হলে থিয়েটার করতি কী করে? নিজের পরিশ্রম করা টাকায় লেখাপড়া করে স্বপ্ন বুনতি কী করে? তুই কোনো চিন্তাই করিস না। তুই ধর্ষিত হসনি! তোকে কেউ হত্যা করেনি!

কয়দিন পর এমনি এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজপথে নেমে আসা উত্তাল জনতা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে পুরোনো জীবনাচারে। এরই মধ্যে জনতার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে অলরেডি। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে পাঁচ জনতা মারা গেছে। নতুন নতুন গরম গরম খুনের খবরে সরব হবে সবাই। তনুর কথা কারো মনেও থাকবে না কিছু। সেই ভালো! সেই ভালো!

কিন্তু এই ভালো আর কত দিন? এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চলবে আর কতকাল? রাষ্ট্র কত দিন নিজের ব্যর্থতার চিহ্ন আড়াল করতে জলজ্যান্ত আলামতকে সহি-সালামতে (নিরাপদে) পাঠিয়ে দেবে? রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কর্তারা কি জানেন না, দুর্গন্ধ ঢেকে রাখা যায় না। সাময়িক এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে নিস্তার মেলে ঠিকই, খানিকবাদেই সেই দুর্গন্ধ প্রবল বেগে আবার নাকে এসে লাগে। দুর্গন্ধ দূর করতে হলে এর উৎপত্তিস্থল সমূলে উৎখাত করতে হবে। নইলে থাবাথুবি দিয়ে খুব বেশিদিন ভুলিয়ে রাখা সম্ভব নয় কিন্তু।

তনুকে ধর্ষণের আলামত না হয় পাওয়া যায়নি, রৌমারীতে ২০১৫-এর জুনে সম্ভবত এক কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে, তার বিচার? সেদিন দুই বোনকে জোর করে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে, তার তো আলামতও পাওয়া গেছে, তার বিচার? গেল সপ্তাহে টাঙ্গাইলে বাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, অপরাধী ধরাও পড়েছে, তার বিচার? ২০১৫-এর সেপ্টেম্বরে মা ও মেয়েকে পরস্পরের সামনে ধর্ষণ করে ১৪ দুর্বৃত্ত। আবার সেটির ভিডিও ধারণ করে, তার বিচার? একই মাসে ঝালকাঠিতে সুন্দরবন-২ লঞ্চের কেবিনে আটকে রেখে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে বখাটে যুবকরা, তার বিচার? রোজ রোজ পত্রিকা খুললেই এই যে এত এত ধর্ষণ-খুনের সংবাদ চোখে পড়ছে, তার বিচার? সব আলামতই কি হাওয়া করে দেওয়া যায়? গেলে কত দিন?

যদি মিথ্যা থাকে, সে মিথ্যার ওপর গড়ে ওঠা সৌধ ধসে পড়বেই, তা আজ হোক বা কাল। তনু, তুই ভালো থাকিস ওপারে। লজ্জা পাওয়ার বা ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতাও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ!

লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।