প্রায় দেড় যুগ আগে গুলশানের নিজ বাড়িতে শাজনীন তাসনিম রহমানকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে করা মামলায় ফাঁসির আদেশ পাওয়া পাঁচ আসামির আপিল শুনানি আজ বুধবার আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে। গত ২৯ মার্চ এ আপিল শুনানি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চে শুরু হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
১৯৯৮ সালে শাজনীন হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৮ বছর পর গত ২৯ মার্চ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের তিন সদস্যের বেঞ্চে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ পাওয়া পাঁচ আসামির আপিলের শুনানি শুরু হয়। তিন সদস্যের ওই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। গতকাল মঙ্গলবার বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে বিষয়টি আজ শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়।
গতকাল আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান। বাদীপক্ষে ছিলেন আইনজীবী নজরুল ইসলাম চৌধুরী, এ এম আমিনউদ্দিন, এস এম আবদুল মবিন ও সরোয়ার আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল খোন্দকার দিলিরুজ্জামান।
যেভাবে দেড় যুগ পার: মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে গুলশানে নিজ বাড়িতে খুন হন শাজনীন তাসনিম রহমান। এ ঘটনায় পরদিন শাজনীনের বাবা লতিফুর রহমান গুলশান থানায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় একটি হত্যা মামলা করেন। একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ওই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করে সিআইডি। তদন্ত শেষে প্রথম মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-১ এবং দ্বিতীয় মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দুটি মামলাতেই আদালত অভিযোগ গঠন করেন।
মামলা দুটিতে আসামি হলেন শাজনীনের বাড়ির সংস্কারকাজের দায়িত্ব পালনকারী ঠিকাদার সৈয়দ সাজ্জাদ মইনুদ্দিন হাসান ও তাঁর সহকারী বাদল, বাড়ির গৃহভৃত্য শহীদুল ইসলাম (শহীদ), বাড়ির গৃহপরিচারিকা দুই বোন এস্তেমা খাতুন (মিনু) ও পারভীন এবং কাঠমিস্ত্রি শনিরাম মণ্ডল।
পরে দুটি মামলারই অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন আসামিরা। ১৯৯৯ সালের ৬ জুলাই বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল করিম ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের (পরে প্রধান বিচারপতি) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজের আদালতে বিচারাধীন হত্যা মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। কারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ইতিমধ্যে আসামিদের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বিচারাধীন ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটির কার্যক্রম চলবে।
ওই রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, ধর্ষণ ও হত্যা দুটি পৃথক অপরাধ, একটি আরেকটি থেকে আলাদা। উল্লেখ্য, শাজনীনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, তাঁকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে।
এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল বিভাগে যান। ১৯৯৯ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান (পরে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি এ এম মাহমুদুর রহমান ও বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর (পরে প্রধান বিচারপতি) সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের বেঞ্চ আসামিদের আপিল আবেদন খারিজ করে দেন। সর্বোচ্চ আদালত রায়ে বলেন, হাইকোর্ট সঠিকভাবেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে চলা মামলাটির কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দিয়ে অন্য মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলেছেন। এটা এমন একটি মামলা, যেখানে ধর্ষণের সময় হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। বরং স্পষ্টত এখানে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ধর্ষণ ও হত্যা দুটি আলাদা অপরাধ এবং এ ক্ষেত্রে একই অপরাধে দুবার বিচার হওয়ার ঘটনা ঘটবে না।
সর্বোচ্চ আদালত থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলাটির বিচার চলতে থাকে। ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক কাজী রহমতউল্লাহ মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে শাজনীনকে ধর্ষণ ও খুনের পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার দায়ে ছয় আসামিকেই ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর এই মামলার মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে যায়। একই সঙ্গে আসামিরাও আপিল করেন। ২০০৬ সালের ১০ জুলাই হাইকোর্ট পাঁচ আসামি হাসান, শহীদ, বাদল, মিনু ও পারভীনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। তবে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আরেক আসামি শনিরামকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন চার আসামি হাসান, বাদল, মিনু ও পারভীন। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল সাজাপ্রাপ্ত চার আসামির লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। ফাঁসির আদেশ পাওয়া আরেক আসামি শহীদ জেল আপিল করেন। প্রায় সাত বছর পর ২৯ মার্চ ওই পাঁচ আসামির আপিলের শুনানি একসঙ্গে শুরু হয়।