বয়স তখনও ১৮ পূর্ণ হয়নি, অবশিষ্ট আছে তিন দিন। দলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। দূরন্তপনায় সবাইকে ছাড়িয়ে। কৌতুহলেরও কমতি নেই। সেই ছেলেটিই কি না জাহির খানকে লং অনের উপর দিয়ে মারল ছক্কা ! তাও আবার সে সময়ের অন্যতম সেরা পেস বোলার জাহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে! যেন থাপ্পড়ের চেয়েও বেশি কিছু। ওই ছক্কার আগে এক ওভারে এক্সট্রা কভার এবং পয়েন্ট দিয়ে দু’টো বাউন্ডারি নিয়েও কম গবেষণা হয়নি। ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে তামিমের ৫৩ বলে ৫১ রানের ওই ইনিংসই বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। ২০০৭-এর বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো ওই ইনিংসে তামিমকে নিয়ে সে কি মাতামাতি! তাঁর পারফরম্যান্স দেখে ভিভ রিচার্ডসের মতো ক্রিকেটারও তামিমের মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ দেখেছিলেন। তিন দিন পর ত্রিনিদাদের হোটেল হিলটনে তামিমের ১৮তম জন্মদিন সেলিব্রেট করা হয়। সেখানে হাজির ছিলেন দ্রাবিড়,শচীনও। তিন দিন আগে মার খেয়েছেন যে তামিমের হাতে, তাঁকে জন্মদিনে শুভকামনা জানাতে এসেছেন এই দুই লেজেন্ডারি ! এটাই যে ক্রিকেটীয় ভদ্রতা। পারফরম্যান্সের হাততালি যে প্রতিপক্ষের কাছ থেকেও প্রত্যাশিত!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি ভারতের বিপক্ষে, তাতেই নিজের জাত চিনিয়েছেন গোটা বিশ্বকে। এই প্রতিপক্ষকে পেলেই যেন একটু বেশিই চাঙ্গা থাকেন এই বাঁ হাতি ওপেনার। টেস্ট এবং ওয়ানডেতে তামিমের পরিসংখ্যানও বলছে সে কথাই। ভারতের বিপক্ষে ৩টি টেস্টে একটা সেঞ্চুরি, একটা হাফসেঞ্চুরি। গড়টাও ঈর্ষণীয় ( ৫৩.৮০)। ওয়ানডেতে সেখানে প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ১৭ ম্যাচে ৬টি হাফসেঞ্চুরি। আছে ভারতের বিপক্ষে ৫০ ওভারের ম্যাচে ২ বার ব্যাক টু ব্যাক ফিফটি। ভারতের বিপক্ষে ৬টি হাফসেঞ্চুরির তিনটিকে আবার রূপ দিতে পেরেছেন ম্যাচ উইনিং ইনিংসে। ত্রিনিদাদে ২০০৭ বিশ্বকাপে ৫১, মীরপুরে ২০১২ সালে এশিয়া কাপে ৭০, গত বছর ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে একই ভেন্যুতে ৬০। তামিমের এই তিনটি ইনিংসে তিন তিনটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ -এর বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদে তামিমের হাফসেঞ্চুরিতে প্রথম পর্বের বাধা পেরিয়ে সুপার এইটে পৌঁছয় বাংলাদেশ। ২০১২-র এশিয়া কাপে প্রথম বারের মতো ফাইনালে খেলার কৃতিত্বও সেবারই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি ইনিংসে বিস্ময় অধ্যায় রচনায়ও সচিনের কৃতিত্বকেও ম্লান করেছেন তামিম। তামিমময় ওই দু’টি ম্যাচে হেরে দু’টি মেগা আসর থেকে বিদায় নেয় ভারত। গত বছর তামিমের সর্বশেষ হাফ সেঞ্চুরির ম্যাচে হেরে ভারত যে ধাক্কাটা খেল সিরিজের প্রথম ম্যাচে, তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথম বারের মতো দ্বি-পাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজে ২-১ এ হেরে যায় ভারত।
টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ২০০ রানের পার্টনারশিপের রেকর্ডেও অংশীদার তামীম। এবং সেখানেও প্রতিপক্ষের নাম ভারত। ভারতের বিপক্ষে খেলতে এসে নিজের সেরা খেলাটা দেওয়ার তাগিদটা অন্যদের মতো তাঁরও অনুভূত হয়, জানিয়েছেন এই বাঁ হাতি ওপেনার। তিনি বলেন, “ভারত শক্তিশালী একটি দল। তাদের সঙ্গে খেলতে এসে তাই ভিন্ন ধরনের অনুভূতি থাকাটাই স্বাভাবিক।”
৬ মার্চ প্রিয় ভেন্যু শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ট্রফির লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ সেই ভারতকেই পাচ্ছেন তামিম। অতীত স্মৃতি রোমন্থনে নিজের ভাবনার পরিধি সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতি নন তামীম। তাঁর কথায়, “ভারতের বিপক্ষে আগে মোটামুটি কিছু ভাল ইনিংস খেলেছি। ওই সব স্মৃতি তো অবশ্যই মনে পড়বে। প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমরা যদি আমাদের মতো খেলি, তা হলে আমরা যে কোনও দলকেই হারাতে পারি। যা আমরা প্রমাণ করেছি। ভারতকে সর্বশেষ সিরিজে হারিয়েছি। কিন্তু এগুলো এখন অতীত। রবিবার কিন্তু নতুন একটি দিন। যাতে দল উপকৃত হয়, তেমন পরিকল্পিত ক্রিকেট খেলতে চাই। আমরা যদি ভুল কম করি, তাহলে ভাল সম্ভাবনা আছে।”
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ( বিপিএল) ‘থ্রি’-তে ৯ ম্যাচে ২৯৮ রান ( গড় ৩৭.২৫), পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) সেখানে ৬ ম্যাচে ২৬৭ ( গড় ৬৬.৭৫)। সংক্ষিপ্ত ভার্সনের ক্রিকেটে ফর্মের তুঙ্গেই আছেন তামীম। এশিয়া কাপে খেলা থেকে বিরত থাকতে চেয়ে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। ২ দিনের নবজাতক পুত্র সন্তানকে রেখে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় এসে তাই নিজেকে চেনাতে পারেননি। পাকিস্তানের বিপক্ষে থেমেছেন ৭ রানে। তবে ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারত। ওই দিনকে নিজেকে উজার করে গিতে চান তামিম। তিনি বলেন, “ শেষ ম্যাচে একটু বেশি নার্ভাস ছিলাম, তা ঠিক। ক্রিকেটের বাইরে ১০-১২ দিন কাটিয়ে ওখান ( ব্যাংকক) থেকে এসে খেলাটা আমার জন্য একটু কঠিন ছিল। তবে ফাইনালের আগে ২-৩টি অনুশীলন সেশন পেলাম। তাতে আমার জন্য ভালই হয়েছে। টি-২০ ফরম্যাটে সম্প্রতি যেভাবে সফল হয়েছি, চেষ্টা করবো সেভাবে নিজেকে এগিয়ে নিতে। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে ওই দিনটি আমার হবে।”
অভিজ্ঞ নেহরার সঙ্গে রয়েছেন বুমরা, হার্দিক পান্ডে। ভারতের পেস ত্রয়ী এশিয়া কাপে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এই তিন জনকে নিয়েই গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশ শিবিরে। তাঁদেরকে খেলার কৌশলটাও শেখাচ্ছেন কোচ হাতুরুসিংহে। তবে বুমরাকে নিয়ে একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হচ্ছে তামিমকে। তাঁর কথায়, “বিশেষ কোনও একজনের নাম বলব না। তারা প্রত্যেকেই ভাল বোলার। বুমরার বিষয়ে কথা হয়েছে। ওর বোলিং টিভিতেও দেখেছি। যতটা সম্ভব বুমরাকে নিয়ে আমি হোমওয়ার্ক করছি। ভারতের সবাই দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান। তার পরেও আমরা আমাদের নিয়েই ভাবছি। একটি খারাপ বল পেলে তার সদ্বব্যবহার কিভাবে করা যায়, আর ভাল বল হলে তাকে কতটা সমীহ করতে হবে, আমাদের ভাবনা জুড়ে এখন এটাই।”
জন্মদিনকে সামনে রেখে যে দু’বার ভারতের বিপক্ষে হাফসেঞ্চুরি করেছেন তামিম, ওই দু’টি ইনিংসই হয়েছে বাংলাদেশের উৎসবের উপলক্ষ। ২০০৭ সালে ১৮তম জন্মদিনকে সামনে রেখে তামিমের ইনিংসে নিস্তব্ধতা ভেঙে মধ্যরাতে উৎসব করেছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে ভারতের বিপক্ষে ফিফটির ইনিংসটি ছিল ২৩ বছর পূর্তির ৪ দিন আগে। ওই জয়ে এশিয়া কাপে ফাইনালের পথটা সুগম হয়েছে বাংলাদেশের। প্রথম বারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালেও খেলেছে বাংলাদেশ সেই বছর। ২৭তম জন্মদিন পালনে অপেক্ষা তামিমের ১৫দিন। নিজের পারফরম্যান্সে প্রথম বারের মতো এশিয়া কাপের ট্রফিতে হাত দেয়ার প্রেরণাও যে দিচ্ছে প্রিয় প্রতিপক্ষ ভারত এবং নিজের জন্মদিন।