কলকাতায় কিছু মার্কামারা প্যাশনেট-পেটুক আছেন।
এই ভোজন রসিকেরা মাঝেমধ্যে ঢাকা ফ্লাইটে চড়ে বসেন স্রেফ গুলশনের বিখ্যাত কোরিয়ান রেস্তোরাঁয় যাবেন বলে। কেউ চল্লিশ মিনিটের বিমানযাত্রাটা করেন ফকরুদ্দিনের বিরিয়ানি খেতে। কেউ ধানসিঁড়ি বা কস্তুরীর ইলিশ চাখতে। দ্রুত আবার এক দিনের মধ্যে কলকাতায় ফেরত।
কলকাতার ক্রিকেট-ফুডির সংখ্যা তুলনায় অগুনতি। মাত্র চল্লিশ মিনিটের একটা ফ্লাইট ধরে এঁদের একটা বড় অংশের অবশ্যই উড়ে আসা উচিত শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে। আজকের পাকিস্তান বনাম আমিরশাহি টাইপের ম্যাচ নয়। যে দিন বাংলাদেশের খেলা থাকবে!
একটা গোটা জাতি কী ভাবে তার যাবতীয় উচ্চাকাঙ্খা, আবেগ, ভীতি, সন্দেহ, উৎকণ্ঠা, জয়োল্লাস, দুর্ভাবনা সমেত ক্রিকেট ব্যাটের তলায় সমর্পিত থাকতে পারে, মীরপুর স্টেডিয়াম না এলে বোঝা সম্ভব নয়। সত্তর দশকের ইডেন তুলনা হতে পারত। কিন্তু এখনকার ইডেন নয়। তারা তো সচিনের বিদায়ী টেস্টেই আসা প্রয়োজন মনে করেনি। গোটা উপমহাদেশে ঢাকার মাঠই এই মুহূর্তে ক্রিকেটের নন্দনকানন।
সোমবার বাংলাদেশের বইমেলার শেষ দিনে ঢুকতে গিয়ে বাংলা অ্যাকাডেমি চত্বরের ঠিক বাইরে বিলবোর্ডটা চোখে পড়ল! অমর একুশ গ্রন্থমেলার একেবারে প্রবেশপথে— ছবি সহ লেখা।
অভিজিৎ রায় হারলে হারবে বাংলাদেশ!
মার্কিন-নিবাসী ব্লগারের রক্তের দাগ এক বছর পরেও শহরের বুক থেকে, মন থেকে, শিরা থেকে মেলায়নি। কিন্তু কাল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টি-টোয়েন্টি জয় দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর জাতীয় ক্রিকেট এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই একতার মন্ত্র যা নানা বিভেদ, বিশ্বাস, সাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং দ্বন্দ্বকে চাপা দিয়ে গোটা জাতিকে এক মঞ্চে রাখতে পারে। মুক্তচিন্তার ব্লগার এবং তার আততায়ীকে মিলিয়ে দিতে পারে মাশরফিদের জন্য গর্জন তুলতে।
বইমেলায় হুমায়ুন আহমেদের বই বিক্রি হচ্ছে ফাউন্টেন পেপসির মতো অনর্গল। কলকাতা বইমেলাও বোধহয় অধুনা এতটা সুনীলময় নয়, বাংলাদেশ গ্রন্থমেলা যতটা হুমায়ুনে আচ্ছন্ন। কিন্তু মাশরফির উপর ক্রিকেট সাংবাদিকের লেখা বইটাও তো তৃতীয় সংস্করণে পৌঁছে গিয়েছে। কোনও ক্রিকেটারের ওপর লেখা ৬৭৫ টাকার দামী বই এত বিক্রি থেকেই তো জাতির ক্রিকেট-পাগলামির দস্তুর বোঝা যায়। মীরপুর স্টেডিয়ামের ঠিক উল্টো ফুটপাথে আইসক্রিমের স্টিক হাতে সাকিব আল হাসানের একটা বিজ্ঞাপন রয়েছে।
অ্যাত্তো ইয়ামি বেরিয়ে আসে বাচ্চামি।
ক্রিকেট সেই ইয়ামি স্বাদ নিয়ে এশিয়া কাপে উপস্থিত। যেখানে বয়স্করাও দেশের সাফল্যে উদ্বেলিত বাচ্চামি দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশ যদি এহেন এশিয়া কাপের হৃদয় হয়, মস্তিষ্ক হল ভারত। বিশ্বকাপ ফুটবলের উপমায় বাংলাদেশ হল আবেগ-নির্ভর, অনিশ্চিত আর্জেন্তিনা। ভারত তথাকথিত দুর্ভেদ্য, নিশ্ছিদ্র জার্মানি।
মঙ্গলবার ধোনির ভারত পড়ছে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। সেই শ্রীলঙ্কা, যারা শুধু গত বারের এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়নই নয়। পিঠোপিঠি এ মাঠ থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মুকুট নিয়ে যাওয়া দল। সংঘাত বিচারে মেগা ম্যাচ। ধোনির ভারতকেই না হারিয়েছিল মীরপুরের ওই ফাইনালে। সে দিন স্লো ব্যাটিংয়ের জন্য অভিযুক্ত যুবরাজ সিংহের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। ধোনির ফাইনাল লাককে গুঁড়িয়ে দিয়ে সঙ্গকারা-মাহেলারা ট্রফি নিয়ে গিয়েছিলেন।
শ্রীলঙ্কার সেই টিম যদি প্রবল পরাক্রান্ত সিন্ধু সভ্যতা হয়, এ বারে যারা এসেছে তারা নিশ্চয়ই এ কালের মহেঞ্জোদাড়ো। না আছেন সঙ্গা, না মাহেলা। বাংলাদেশ কাল তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ঢাকার শহরবাসী থেকে স্থানীয় এফএমের ডিজে সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ভারতের জয় নিতান্ত নিয়মরক্ষার হবে।
সূচি অনুযায়ী বুধবার পাকিস্তান-বাংলাদেশ। ধরে নেওয়া হচ্ছে এক দিক থেকে ভারত স্বচ্ছন্দে উঠবে। অন্য দিকের অঘোষিত সেমিফাইনাল বুধবারই। যারা জিতবে তাদের ভারতের সঙ্গে ফাইনাল। আমিরশাহিকে হারাতেই এ দিন পাকিস্তানি ব্যাটিংয়ের যেমন দাঁতকপাটি উড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল, তাতে লিপ ইয়ারে অনেকেই অঘটনের নিশ্চিত চিত্র দেখছিলেন। আফ্রিদির পাকিস্তান ৩ উইকেটে ১৭ থেকে কোনওক্রমে উদ্ধার পেলেও বাংলাদেশবাসী যে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে, বিচিত্র কী!
মুস্তাফিজুর রহমান চোট পেয়ে সোমবার টুর্নামেন্টের বাইরে চলে গেলেন। তামিম ইকবাল যতই তাঁর জায়গায় ঢুকুন, আয়োজক দেশের এটা বিশাল ধাক্কা। ঘটনা হল, বন্য আবেগ কবে অঙ্কের তোয়াক্কা করেছে? কোটি কোটি বাংলাদেশবাসী দেখছে, ফাইনালে ভারত বনাম তারা! তার পর তাজ যে মাথাতেই যাক!
সাধারণ ভাবে মনে করা হয়ে থাকে একটা টিম কেমন অভ্যন্তরীণ মেজাজে আছে সেটা বোঝার সেরা উপায় জিম বা ব্রেকফাস্ট টেবলে তাদের পারস্পরিক শরীরীভাষা দেখা। তা সোমবার ঢাকা এয়ারপোর্টের নিকটবর্তী লা মেরিডিয়ানের পনেরো তলায় কোহলিদের দেখে মনে হল তাঁরা এক-এক জন খুব ভাল স্পেসে আছেন। নীরব অথচ আক্রমণাত্মক আত্মবিশ্বাস টিমটায় বিরাজ করছে। সন্দেহ নেই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সুসংহত দল যারা মীরপুর মাঠে তৈরি তিন রকম সারফেসেই মানানোর মতো প্লেয়ার স্কোয়াডে এনেছে। যাদের রিজার্ভে বসে থাকা দু’জন এশিয়া কাপের যে কোনও টিমে চান্স পাবেন। হরভজন আর রাহানে।
টি-টোয়েন্টি অনিশ্চয়তার বলয় ওয়ান ডে-র চেয়েও বৃহত্তর। কিন্তু যে দলকে ভেতর থেকে এত গোছানো লাগছে, তাদের অভ্যন্তরীণ ট্রান্সফর্মার জ্বালিয়ে দিতে হলে বিপক্ষকে চমকপ্রদ কিছু করতে হবে।
যতক্ষণ না সেটা ঘটছে, টুর্নামেন্টের বৃহত্তম স্মৃতিমেদুরতা হয়ে থাকবে বিরাট কোহলির ইনিংসটা। আর বাইশ গজের বাইরে সেটা খুঁজলে অনিবার্য ভাবে বাংলাদেশ ম্যাচের গ্যালারি। যখন হাজার হাজার মোবাইলের ভিডিও বাটন পুশ করে তার আলোয় স্টেডিয়ামের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত প্রজ্জ্বলিত রাখছেন সমর্থকেরা।
আধুনিক ক্রিকেট মাঠের সবচেয়ে অপরূপ দৃশ্য। ইডেনে মশাল জ্বলা শুরু হয়েছিল সত্তরে ইস্টবেঙ্গল পাজ ক্লাবকে হারানোর পর। মেক্সিকান ওয়েভ শুরু ছিয়াশির বিশ্বকাপে। মীরপুর দিল মোবাইল ক্যামেরার ভিডিও আলো। অসামান্য এই দৃশ্যকল্প— সবুজ মাঠের পিছনে হলুদ আলোর বিশাল ক্যানভাস।
কোহলির ব্যাট যদি মস্তিষ্ক হয়, ওই আলোর রাশি তো সত্যি আবেগ!