হাত থেকে বলটা যখন ছিটকে বেরিয়ে গেল, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য কি হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল সাকিবের? দ্বিতীয় চেষ্টায় বলটিকে ক্যাচ বানানোর আগে নিমেষের জন্য কি মনে হয়েছিল, ‘থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি’!
ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে রোহিত শর্মার ক্যাচ ফেলার পর চারপাশ থেকে সমালোচনার তির এসে বিঁধেছে গায়ে। সেই ক্যাচ ফেলার তাৎপর্য বুঝতে সময় লেগেছিল। এটির ক্ষেত্রে সেই সমস্যা ছিল না। তখনই বলে দেওয়া যেত, ক্যাচ নয়, ম্যাচটিই হাত থেকে ফেলে দিলেন সাকিব।
বাংলাদেশ আর জয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তখন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। সেই ম্যাথুসের ক্যাচ। যেটির আগ পর্যন্ত ম্যাচের সমীকরণ—বল বাকি ১৮টি, শ্রীলঙ্কার চাই ৪৬ রান। সাকিবের হাত থেকে ক্যাচ, থুড়ি ম্যাচটা ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পড়িমরি করে তা ধরে ফেললেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয়ের গল্পটাও আসলে লেখা হয়ে গেল তখনই।
আল আমিন যখন শেষ ওভারটি করতে এলেন, সেটি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাস এমন নিরুদ্বিগ্ন শেষ ওভার আর কখনো দেখেনি। কাগজে-কলমে তখনো শ্রীলঙ্কা ম্যাচে আছে। তবে ৬ বলে ৩২ রান শুধু গাণিতিকভাবেই সম্ভব, মাঠের খেলায় নয়। সেই ওভারে একটা ছক্কা খেলেন আল আমিন, তাতে কি আসে যায়! ওই ছক্কা নয়, তিনি বরং মনে রাখবেন বোনাস হিসেবে পেয়ে যাওয়া দুটি উইকেট।
বাংলাদেশ যেমন এই ম্যাচটা মনে রাখবে টি-টোয়েন্টির নতুন যুগের সূচনা হিসেবে। ওয়ানডেতে প্রবল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েও টি-টোয়েন্টিতে নেহাতই হরিজন মাশরাফির দলে এখন ছড়িয়ে যাবে এই বিশ্বাস, ‘ছোট ক্রিকেটেও এখন আর আমরা ছোট দল নই।’
মেলবোর্নে বিশ্বকাপের ম্যাচের প্রায় এক বছর পর আবার দেখা দুদলের। এই শ্রীলঙ্কা একটু অচেনাই। শ্রীলঙ্কা মানেই তো ক্যান্ডির এক বাঁহাতির অত্যাচার। সঙ্গে এক ডানহাতির ব্যাটে রেশমি পরশ। সেই সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনে এখন ক্রিকেট-অতীতের অ্যালবামে স্থির ছবি। হাঁটুর চোট এই ম্যাচে দর্শক বানিয়ে রাখল লাসিথ মালিঙ্গাকেও।
শ্রীলঙ্কাকে হারানোর এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলে তা বড় দুঃখের ব্যাপার হতো। ম্যাচের শুরুটা অবশ্য সেই দুঃখগাথার সূচনা বলেই মনে হচ্ছিল। প্রায় ৩৮ মাস পর শ্রীলঙ্কার পক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ম্যাথুসের টস করতে নামা। সেটিরই উদ্যাপন প্রথম ওভারেই উইকেট নিয়ে। অধিনায়কত্বের সঙ্গে অবশ্য এটা মেলানো ঠিক হলো না। একসময় ওয়ানডেতে যেমন ছিলেন চামিন্ডা ভাস, টি-টোয়েন্টিতে তেমনি ম্যাথুস। প্রথম ওভারেই উইকেট নেওয়াটা যিনি অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। কাল দশমবারের মতো শুরুতেই উইকেট। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর নিজের দলেই। কাল নতুন বলে তাঁর সঙ্গী নুয়ান কুলাসেকারা। তাঁরও প্রথম ওভারেই উইকেট। ক্যারিয়ারে নবমবারের মতো।
ম্যাচের বয়স দেড় ওভার, স্কোরবোর্ডে ২/২। দুই ওপেনারই শূন্য রানে আউট। ৩ ওভার শেষে স্কোর ২ উইকেটে ৬। সাব্বির সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার কিছু একটা না করলে শ্রীলঙ্কানরা আরও ঘাড়ে চেপে বসবে। কুলাসেকারার ওভারের প্রথম চারটি বল ছুটে গেল মাঠের চার কোণে, দ্বিতীয়টি হাওয়ায় ভেসে। যে ৬৫ মিনিট উইকেটে ছিলেন, মুগ্ধতা ছড়ানো সব শটে ছড়িয়ে দিলেন বার্তাটা—এটি বোধ হয় বাংলাদেশেরই রাত!
৬ ওভারের পাওয়ার প্লে শেষে বাংলাদেশের স্কোর ৪১, এর ৩৫-ই সাব্বিরের ব্যাট থেকে। ২০ ওভার শেষেও বাংলাদেশের ইনিংস একই রকম সাব্বিরময়। ৫৪ বলে তাঁর ৮০ রান। অতিরিক্ত ধরেও দলের বাকি সাত ব্যাটসম্যানের যেখানে ৬৬ বলে ৬৭।
ছেলেমানুষি ভুলে মুশফিকুরের রান আউটে বাংলাদেশ যখন ৩ উইকেটে ২৬, সাব্বির সঙ্গী পেলেন সাকিবকে। এই ‘সা-সা’ জুটিতেই নিকষ অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল আলোতে উদ্ধার। আলো তখন গ্যালারিতেও।
গত কিছুদিন মিরপুরে দর্শকেরা এক নতুন খেলায় মেতেছেন। হঠাৎই সবার হাতে হাতে মোবাইলের বাতি জ্বলে উঠে যেন সহস্র তারায় সেজে ওঠে গ্যালারি। সাব্বিরের ব্যাটেও কাল এমনই তারার ঝিকিমিকি। ছক্কা মেরে ফিফটি, আউটও ছক্কা মারতে গিয়েই। চামিরার আগের বলেই ছক্কা মেরেছিলেন। ছক্কা মারার নেশায় পেয়ে না বসলে একটা অপূর্ণতা ঘুচিয়ে দিতে পারতেন সাব্বির। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেরই এখনো টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি নেই। সাব্বির আউট হওয়ার সময় চার ওভার বাকি, এর অর্ধেকও থাকতে পারলে সাব্বিরকে সেঞ্চুরিবঞ্চিত করার সাধ্য ছিল না শ্রীলঙ্কার এই বোলিংয়ের।
বিরতির সময় টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সাকিব বললেন, রানটা ১৬০ হলে ভালো হতো। এই উইকেটে এটা ‘পার’ স্কোর। সেই ‘পার’ স্কোরকেই শ্রীলঙ্কার জন্য অগম্য এক বন্দর বানিয়ে ফেললেন বাংলাদেশের বোলাররা। সেটির নেতৃত্বেও সাকিব। প্রথম বলেই ফেরালেন শ্রীলঙ্কার এই দলের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান তিলকরত্নে দিলশানকে। শেহান জয়াসুরিয়া যখন আরেক জয়াসুরিয়ার কথা একটু-আধটু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ফেরালেন তাঁকেও। উদ্যাপনের ভঙ্গিই বুঝিয়ে দিল, গত কিছুদিনের ‘অসাকিবীয়’ পারফরম্যান্সে ভেতরে ভেতরে কেমন ফুঁসছিলেন!
সাকিব পুরোভাগে থাকতে পারেন, তবে এই জয় সম্মিলিত বোলিং পারফরম্যান্সের। নতুন বলে দুর্দান্ত তাসকিন ও আল আমিন। ভারতের বিপক্ষে বিবর্ণ মুস্তাফিজ আবারও আবির্ভূত সেই রহস্যময় বোলার হয়ে। উইকেট ১টি, কিন্তু ৪ ওভারে রান দিলেন মাত্র ১৯।
তাসকিনের প্রথম ওভারেই স্লিপে ক্যাচ ফেলেছিলেন সৌম্য। সেটি ভুলিয়ে দিলেন মিড অফ থেকে বাউন্ডারির দিকে দৌড়ে নেওয়া অসাধারণ এক ক্যাচে। ওই ক্যাচেই দিলশানের মৃত্যু।
পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের নতুন যুগে প্রবেশও!