বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ও সময় টেলিভিশনের সাবেক উপস্থাপক গোলাম রাব্বীকে মধ্যরাত অবধি হয়রানি ও নির্যাতনের খবর তোলপাড় করেছে মিডিয়া জগত। এসআই মাসুদ শিকদারের বিচারের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে রীতি মতো ঝড় উঠছে। এ থেকে বাদ যায়নি বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকরাও। নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পুলিশী হয়রানি আর ক্ষোভ ফুটে উঠেছে তাদের মন্তব্যে।
সাংবাদিক ও আইনজীবীদের অনেকে লম্বা স্ট্যাটাসে নিজেদের শঙ্কার কথা, বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন। অনেকে স্ট্যাটাসের পক্ষে ও বিপক্ষেও মন্তব্য করেছেন।
সাপ্তাহিক নতুনদেশ পত্রিকার প্রকাশক শওগাত আলী সাগর তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘এসআই মাসুদ শিকদার যা করেছে তা কোনো নতুন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রাব্বী যেটি করেছেন- সেটি বরং ব্যতিক্রম। হরহামেশাই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। সবাই রাব্বীর মতো প্রকাশ্যে অভিযোগ করতে পারে না, সবাই হয়তো বা ফিরেও আসে না। …… এসআই মাসুদ শিকদারের ঘটনা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। আমি অপেক্ষায় আছি রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার। এখন পর্যন্ত সরকারের কেউ, মানে কোনো জনপ্রতিনিধি, পুলিশের বড় কর্তারা- কেউ কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন বলে চোখে পড়েনি।
তিনি আরো লিখেছেন, আমরা কি ‘জংলী শাসনে’ আছি, নাকি এখনো শাসনতন্ত্রে সভ্যতার লেশমাত্র আছে- তা বুঝতে হলে রাব্বীর ঘটনায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াটা আগে দেখতে হবে।
ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট শিমুল বাশার স্ট্যাটাসে নিজের অভিজ্ঞতার শেয়ার করে লিখেছেন, ‘মধ্যরাতে সিএনজি নিয়ে একা একা বাসায় ফিরতে হয় প্রায়ই। যাত্রাপথে কমপক্ষে তিন থেকে চারটি চেকপোষ্টে আমাকে থামতে হয়। একরাতে প্রফেশান জানতে পেরে এক পুলিশ আমার আইডি কার্ড দেখতে চাইলেন, দেখালাম। আইডি কার্ডে তার সন্দেহের উপশম হোল না হয়তো…তিনি আমাকে সার্চ করতে চাইলেন। সেদিন আমার মন মেজাজ খুব বেশি ভালো ছিল না। বললাম, আইডি দেখানোর পরও যদি সার্চ করতে হয়.. তাহলে আইডি দেখলেন কেন? চেকপোষ্টের পুলিশ কারো কাছ থেকে খুব বেশি বাড়তি কথা শুনতে পছন্দ করেন না।
আমার কথা শুনে দু’জন পুলিশ সদস্য এগিয়ে এলেন, রাগ কণ্ঠে বললেন, সাংবাদিকরা কি খারাপ কাজ করে না…আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, না করে না এরপর বললাম, আপনাদের ডিউটিকে আমি সম্মান করি কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর দেন তো…আপনাদের কি সত্যিই মনে হয়, মাঝরাতে কোন দুঃস্কৃতিকারী সিএনজিতে অবৈধ মালামাল বা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে একাধিক চেকপোষ্ট বসানো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করবে…তাও আবার একা? এক কথা- দু’কথায় তর্ক লাগার উপক্রম হোল… আসলে যাত্রীদের কোনই হয়রানি হয় না…যে যাত্রীর ঢাকা শহরে মাঝরাতে সিএনজিতে যাতায়াত করতে হয় সে এমনিতেই হয়রান থাকে। প্রকৃতপক্ষে হয়রানির শিকার পুলিশ সদস্যরাই। ডিউটিতে এসে ওদের প্রায় প্রতিটি সিএনজিকেই থামাতে হয় কারণ ওদের কাছে কোন ওয়ারেন্ট, গোপন খবর কিংবা গোয়েন্দা তথ্য কিছুই থাকেনা বা আসেনা। কিছু আনস্মার্ট, আহাম্মক পুলিশ সদস্যদের জন্যে ওই ডিপার্টমেন্টের ইল-ফেইম হচ্ছে…এই স্ট্যাটাসটা নিশ্চয়ই আমার পুলিশ বন্ধুদের নজরে আসবে।
প্রথম আলোর সিটি এডিটর কামরুল ইসলাম নিজের স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ক্লোজ কোনো শাস্তি নয়, পুলিশ প্রবিধান বা পুলিশ আইনে ক্লোজ বলে কোনো সাজা নেই।’
এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগের কেউ অপরাধ করে ধরা পড়ে গেলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পুলিশের কেউ অপরাধ করে ধরা পড়ে গেলে তাকে ক্লোজ করা হয়। বহিষ্কার বা ক্লোজ কোন ধারার শাস্তি ?’
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার শরিফুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এই ধরনের অসভ্য পুলিশ সদস্যদের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার যাতে আর কোন অসভ্য এমন বর্বরতা চালানোর সাহস না দেখায়।’ এরপর তিনি প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট নিউজটি শেয়ার করেছেন।
অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের রিপোর্টার তাইমুর রহমান শুভ লিখেছেন, ‘পুলিশ বাহিনীতে এখন মাসুদ শিকদারদের বড় প্রয়োজন। তদন্ত শেষে এসআই মাসুদ শিকদাররা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কারণ তাদের টাকাতেই কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, সন্তানের উচ্চতর পড়ালেখা চলে। চেইন রিঅ্যাকশনের মতো এসব কর্মকর্তাদের ঘরে আবার ঐশীদের মতই সন্তানের জন্ম হয়। …… সাবাস।’
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার গোলাম মোস্তফা অন্তু লিখেছেন, ‘সমস্যাটা হচ্ছে আপনি যখন কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়া বা নিপীড়নের একটা অভিযোগ তুলবেন তখন সেই লোকটি নিজে বাঁচতে আপনার বিরুদ্ধে হাজারটা অভিযোগ তৈরি করবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কান ভারী করবেন। অবধারিতভাবে এসব অভিযোগের ভেতরে এটা থাকবে যে আপনি পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বাজে কথা বলেছেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে নিপীড়কের পক্ষে বলা শুরু করেন। যুক্তি ওঠে দোষ না করলে মারলো কেন! আর চাপে পড়ে যদিও কোনো নিপীড়নকারী বা ঘুষখোরের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থা নেয়া হয়। দুদিন পরে তদবীরের চোটে সব রাগ পানি হয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তারা এখনও কেবল পুলিশ বোঝেন, মানুষ বোঝেন না- বুঝতেও চান না।’
চ্যানেল ২৪ এর রিপোর্টার রাশেদ নিজাম লিখেছেন, ‘হায়না, জানোয়ার নাম ব্যাপার না। কিন্তু ক্লোজড করা হয়েছে মাসুদকে। দেখা যাক, আর কি হয়। Rabby মন খারাপ করে থেকো না।’
রেডিও টুডে’র স্টাফ রিপোর্টার কাজী শামীম হাসান লিখেছেন, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক ও সময় টেলিভিশনের সাবেক রিপোর্টার ও নিউজ প্রেজেন্টার গোলাম রাব্বী। কারণ, তিনি বেঁচে ফিরেছেন ক্রসফায়ার থেকে। বেঁচে ফিরেছেন পকেটে গাঁজা/ইয়াবা ঢুকিয়ে মাদক ব্যবসায়ী হওয়ার হাত থেকেও। তবে, সবার কপাল এত ভালো হয় না। আর ওই এসআইয়েরই বা কি দোষ? এটা তো জানাই আছে, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। লাভ নেই, মাথা থেকে পচন শুরু হয়ে গেছে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সুব্রত মন্ডল লিখেছেন, ‘আবারো সাংবাদিকের ওপর পুলিশি নির্যাতন, বড় ভাই গোলাম রাব্বী ভাইয়ের ওপর পুলিশি নির্যাতন এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না, আর কতো দিন নির্দোষ সাংবাদিকরা এভাবে নির্যাতিত হবে।’
দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টার ইয়াসিন রহমান লিখেছেন, ‘এমন ভালো একজন মানুষকে নির্যাতন করায় মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ এর বিচার কামনা করছি।’
লন্ডর প্রবাসী সাংবাদিক ফরিদ এ রেজা লিখেছেন, ‘`ব্যক্তির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্যে স্থানীয় সম্প্রদায়ে সংগঠিত হওয়া এবং স্থানীয় সম্প্রদায়-শক্তি গড়ে তোলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। একমাত্র স্থানীয় সাম্প্রদায়িক ঐক্যই সেই শক্তির সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি আরো লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের অসহায় নাগরিকদের প্রতি আমি বলবো, বাঁচতে হলে স্থানীয় সম্প্রদায়বোধ শক্তিশালী করুন। ব্যক্তিস্বার্থপরতার খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয় পাড়া-মহল্লায় সম্প্রদায়-সম্পর্কে-বন্ধন জীবন্ত করুন।’
অনলাইন পূর্ব-পশ্চিমের স্টাফ রিপোর্টার মোস্তাফিজুর রহমান সুমন লিখেছেন, ‘রাব্বীর নির্যাতনকারীর গ্রেফতার এবং উপযুক্ত বিচার চাই…পুরো বাহিনীর উপর আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই। দোষী একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আমরা সন্তুষ্ট। বিশেষ স্থানে বাড়ি, বিশেষ দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন এবং বিশেষ বাহিনীতে কর্মরত বলেই যাকে খুশি তাকে `ধর মার আর টাকা নে` এমনটা কেনো হবে ?’
আর টিভির প্রডিউসার নুর হোসেন হিরা লিখেছেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ক্লোজে আমার আস্থা নেই। প্রচলিত আইনে মাসুদ শিকদারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে।’
চট্টগ্রাম জর্জকোটের আইনজীবী আসাদুজ্জামান খান প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন, ‘আর চুপ করে থাকা নয়, আর মুখ বুঝে বসে থাকা নয়। আসুন তীব্র প্রতিবাদ করি। যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে গোলাম রাব্বী ভাইয়ের মতোই অবস্থা হবে সকলের।’