তালপট্টি থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বাংলাদেশ: দীপু মনি

SHARE

প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। বাংলাদেশের ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটরিয়াল সমুদ্র। বাংলাদেশের এই সমুদ্র জয়ের পেছনে পরিশ্রম করা ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক স্থায়ী সালিশি আদালত বা পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশনে (পিসিএ) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন। বর্তমানে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। দীপু মনি সোমবার দৈনিক সকালের খবরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তালপট্টির অংশ ভারত পাওয়ায় এ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে কিন্তু তালপট্টি থাকলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতো।image_91538_0

দীপু মনি বলেন, তালপট্টিকে দ্বীপ বলা হয়েছে। আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে তালপট্টি কোনো দ্বীপ নয়, কোনোদিন দ্বীপ ছিল না।  তালপট্টি ছিল লো টাইড অ্যালিভেশন বা ভাটা টিলা, যা ভাটার সময় জেগে ওঠে এবং জোয়ারের সময় তলিয়ে যায়। লো টাইড অ্যালিভেশন দিয়েও বেইজ পয়েন্ট ধরা যায়, যদি সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়। এটি ১৯৭০ সালে সাইক্লোনের সময় সম্ভবত আবির্ভূত হয় এবং ১৯৮৯ সালে উড়িরচরের ঝড়ের সময় এটি হারিয়ে যায়। তারপর এটিকে আর দেখা যায়নি। তালপট্টি ছিল ১ দশমিক ১৩ বর্গকিলোমিটার।

তিনি বলেন, তালপট্টিকে লো টাইড অ্যালিভেশন হিসেবে ভারত বেইজ পয়েন্ট দিয়েছে। বেইজ পয়েন্ট অনুযায়ী যে লাইন টানা হয়েছে তাতে তালপট্টি ভারতের অংশে পড়েছে। ওইখানে যদি দ্বীপ থাকত তাহলে রায়ে ভারত আরো কিছু অংশ পেত; যেহেতু সেটা ভারতের অংশে রয়েছে। যেভাবে আমরা সেন্টমার্টিনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে রায়ে ১২ নটিক্যাল মাইল পেয়েছি। তালপট্টি যেহেতু ছোট তাই কম পেত ভারত। প্রত্যেকটা ভূমির জন্য সমুদ্র এলাকা দেয়া হয়। তালপট্টি থাকলে আমাদের লাইন আরো ভেতরে চলে আসত। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। নেই তাতে আমাদের সুবিধা হয়েছে, জায়গা হারাইনি। যে দ্বীপ নেই সেটা হারানোর কী হলো? আর ভারতেরই-বা পাওয়ার কী হলো? যখন ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা বিরোধপূর্ণ এলাকা দেখতে এসেছিলেন তখন তালপট্টির জায়গায় আমাদের জাহাজ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল।

তালপট্টি ম্যাপ নিয়ে জটিলতা কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, ১৯৮০ সালের পর বাংলাদেশের ম্যাপে তালপট্টিকে ভারতের দিকে দেখানো হচ্ছে। তবে এ নিয়ে জিয়াউর রহমানের তখনকার ভারত সফর নিয়ে অনেক কথ শোনা যায়। কারণ তার সফরের পর থেকেই নাকি বাংলাদেশের কোনো ম্যাপে তালপট্টিকে বাংলাদেশের অংশে দেখানো হয়নি। তবে এ বিষয়টি কি তা পরিষ্কার নয়।

আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যাওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সরকারের করণীয় নিয়ে কাজ করেছি। ১৯৮২ সালে সমুদ্র আইন কনভেনশন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করে। কিন্তু সেটিকে অনুস্বাক্ষর করতে হয়। ১৯৯৬ সালের আগে কোনো সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু করা হয়। সেই সময়েই দু’দেশ মিলে জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। তখন সমুদ্র আইনের কনভেনশনটি অনুস্বাক্ষর করা হয়। এরপর থেকে দিন গোনা শুরু হয়। কারণ অনুস্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে একটি দেশের মহীসোপানের দাবি উত্থাপন করতে হয়। এই আইনের শর্ত অনুযায়ী ২০১১ সালের ২৫ জুলাই সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল দেখে আমরা আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে আমাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে যাই। বিএনপি-জামায়াত জোট এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করেনি। তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা প্রথমে আলোচনা করার উদ্যোগ নিই। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে আলোচনা বন্ধ থাকায় বিষয়টি বেশি এগোবে বলে আমাদের বিশ্বাস ছিল না। তাই হলো। মিয়ানমার এবং ভারত সমদূরত্ব ব্যতিরেকে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণে রাজি নয়। আর সমদূরত্ব হলে আমাদের তটরেখার যে ভৌগোলিক প্রকৃতি, তাতে আমরা ১০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাই। আমাদের সমুদ্রসীমা এলাকা মাত্র ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে আটকে যায়। তারপরই আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বলিষ্ঠ ও সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিজয়টা কার-সরকারের না জনগণের-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অর্থশালী ও বিত্তশালী দুই প্রতিবেশী দেশকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনেকেই ভাবতেই পারতেন না। জননেত্রী শেখ হাসিনা বন্ধুত্বকে অক্ষুণ্ন রেখে সমুদ্রসীমার মতো বিষয়গুলো সমাধান করেছে। তাই বলতেই হবে সমুদ্র বিজয় জনগণের। কারণ তারা শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করেছেন।
আমি যদি নিজে আইনজীবী না হতাম বা আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আমার পড়াশোনা না থাকত তাহলো হয়তো বিষয়টি নিয়ে আমি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব আকারে অনুমোদন চাইতাম না। আরবিট্রেশন নিয়ে আমার পড়াশোনা আছে। আন্তর্জাতিক আদালতে প্রতিবেশী দেশকে নিয়ে যাব, এটা হয়তো ভাবতেই পারতাম না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও অনেক আইনজীবী ছিলেন, তারা কোনো উদ্যোগ নেননি।