বৈদেশিক বাণিজ্যে কৃষি ব্যাংকের প্রায় ৩১৮ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে। ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে পরিচালিত পরিদর্শনে দেখা গেছে, আমদানির বিপরীতে বিভিন্ন গ্রাহককে দেওয়া ঋণ এক পর্যায়ে খেলাপি হওয়ার পরও ব্যাংকের হিসাবে তা নিয়মিত দেখানো হয়েছে। খেলাপি গ্রাহকদের নতুন করে ঋণ সুবিধা দেওয়া, রফতানির অর্থ যথাসময়ে দেশে আনতে না পারাসহ নানা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনিয়ম ধরা পড়ার পর এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে গত নভেম্বরে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিটি অনিয়ম দূর করা হয়েছে মর্মে কৃষি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিতভাবে জানালেও যাচাই করে দেখা যায় যে, ব্যাংকের বক্তব্য সঠিক নয়। কোনো বিষয়ই নিষ্পত্তি না করেই অসত্য তথ্য দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছে ব্যাংক। সার্বিক বিষয়ে ব্যাংকের কাছে পুনরায় ব্যাখ্যা চেয়ে সম্প্রতি আবার চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠির জবাব দেওয়ার শেষ দিন ছিল গত ২৫ জুন। তবে এখনও কোনো জবাব পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কৃষিকাজে ঋণ দিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অকৃষি খাতে ঋণ বিতরণ নিয়ে এমনিতেই নানা প্রশ্ন রয়েছে। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকটিকে অকৃষি খাতে ঋণ বিতরণ না করতে সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, গত মার্চ শেষে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এই খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য-সংক্রান্ত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ ইউসুফ সমকালকে বলেন, মূল ধারা থেকে বেরিয়ে ব্যাংকটি অকৃষি খাতে বেশ কিছু ঋণ বিতরণ করেছে। সেখানে নানা অনিয়মও হয়েছে। তবে এসব ঘটেছে গত অক্টোবরে তিনি দায়িত্বে আসার আগে। এখন বৈদেশিক বাণিজ্য কমিয়ে আনার পাশাপাশি অতীতের অনিয়ম শুধরানের চেষ্টা করছেন তারা। তিনি জানান, ব্যাংকের আর্থিক সূচকের উন্নয়নে বিভিন্ন শাখা ব্যবস্থাপকদের তিনি নিজে ডেকে কথা বলছেন। এসব কারণে জুনের হিসাবে খেলাপি ঋণ ও লোকসান কমে এসেছে। অন্য সূচকেও অগ্রগতি হয়েছে।
ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, শাখার ১০ জন গ্রাহককে দেওয়া আমদানি-সংক্রান্ত এলটিআরের (বিশ্বাসের ঋণ) ১০৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি। অথচ তা দেখানো হচ্ছে নিয়মিত। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যার জবাবে ব্যাংক জানিয়েছিল, ১০ গ্রাহকের মধ্যে ৪ কোটি টাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসির। অন্য দুই গ্রাহকের ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। বাকি ৭টি নিয়মিত আছে। তবে যাচাই করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছে, আসলে ব্যাংকের দেওয়া জবাব সঠিক নয়। একইভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংকের ১৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অসমন্বিত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবেচনায় এ ঋণ খেলাপি হওয়ার কথা থাকলেও ব্যাংক তা নিয়মিত দেখিয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাখ্যা চাওয়ার পর বলা হয়, এর মধ্যে ৬২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা সরকারি মালিকানার বিসিআইসির দায়। বাকি অর্থের মধ্যে ৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা পুনঃতফসিল ও দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। বাকি অর্থ আদায়ের চেষ্টা চলছে। পরে খোঁজ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে আসলে কোনো অর্থ আদায় হয়নি, পুনঃতফসিলের কথাও সঠিক নয়।
অভ্যন্তরীণ বিল কেনা-বেচার বিপরীতে ৭ গ্রাহকের কাছে মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া রয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রীন বাংলা স্পিনিং মিলের ১২ কোটি ৮ লাখ টাকা মন্দামানে শ্রেণীকৃত হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়। এছাড়া ২৯টি গ্রাহকের পিএডি (পেমেন্ট অ্যাগেইনস্ট ডকুমেন্ট) বকেয়া ছিল ১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১০ কোটি ৭১ লাখ টাকা খেলাপিতে পরিণত হলেও তা দেখানো হয় নিয়মিত। মেসার্স বমা লিমিটেডের কাছে ব্যাংকের ৫৭ লাখ টাকার পাওনা খেলাপি হলেও তাও নিয়মিত দেখিয়ে গ্রাহককে নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ১১ গ্রাহকের প্রায় ৮ কোটি টাকার আমদানি দায় বকেয়া থাকার পরও তাদের নিয়মিত ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য উঠে আসার পর ব্যাংক জানিয়েছিল ৯টি বিল ইতিমধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে। অন্য দুটিও সমন্বয় করা হবে।
কৃষিপণ্য রফতানির বিপরীতে ২ জন গ্রাহককে নগদ সহায়তা বাবদ দেওয়া ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা প্রকৃত পক্ষে রফতানি হয়েছে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। হোগলা রফতানির বিপরীতে একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ১ কোটি ৮১ লাখ টাকার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশে শিক্ষার জন্য ৯৩ লাখ টাকা সমমূল্যের প্রায় ১২ হাজার ডলার সমমূল্য ছাড় করতেও কোনো নিয়ম মানা হয়নি। ১৭টি রফতানি বিল অপ্রত্যাবাসিত থাকার বিষয়ে ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ১৭টি বিলের মধ্যে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের ৮টি বিল ও ১২ লাখ ৪৮ হাজার টাকার অপর একটি বিলের একটি উল্লেখযোগ্য অর্থ ইতিমধ্যে চলে এসেছে। বাকি অর্থ আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে এই জবাবের সঠিকতা পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নিয়ম অনুযায়ী, রফতানির বিপরীতে তাৎক্ষণিকভাবে ইএক্সপি ফরম দাখিলের কথা থাকলেও ৬ মাসেও দাখিল করেনি শাখা। ব্যাংক থেকে দেওয়া পিসি ক্রেডিটের ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বকেয়া থাকলেও সে তথ্য গোপন করা হয়। শাখার ৬টি মেয়াদোত্তীর্ণ বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ৬৬ লাখ টাকা। এছাড়া বিদেশি সরবরাহকারীর আর্থিক সচ্ছলতা রিপোর্ট না নিয়ে আমদানি এলসি খোলা, স্থলপথের আমদানিতে নীতিমালা না মানা, নির্ধারিত তারিখে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় পরিশোধ না করাসহ নানা অনিয়ম উঠে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে।