চার মন্ত্রী নিয়ে বিতর্কে চাপে বিজেপি, চাঙ্গা কংগ্রেস

SHARE

modi mযেন পান্তা ভাতে ঘি!

হচ্ছিল স্মার্ট সিটি নিয়ে কথা। দুম করে তারই মধ্যে জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ টেনে এনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ বিতর্কের মুখ ঘোরাতে চাইলেন ঠিকই। কিন্তু বিরোধীরা ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে’ দিলেন না! বরং জাতীয় রাজনীতির বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু অনড় রইল বিজেপি-র চার মন্ত্রীর কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের প্রসঙ্গেই। বিশেষ করে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বসুন্ধরা রাজে-র ইস্তফার দাবিতে বৃহস্পতিবার আরও চাপ বাড়ল সরকারের ওপর।

একে তো বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করা ললিত মোদির একটি হলফনামা এ দিন ঝুলি থেকে বের করেছে কংগ্রেস। ওই হলফনামাতেও বসুন্ধরার উল্লেখ রয়েছে। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার সখ্য কতটা তা-ও হলফনামায় ব্যাখ্যা করেছেন মোদি। তা ছাড়া একটি নতুন ছবিরও উদয় হয়েছে বৃহস্পতিবার, যাতে দেখা যাচ্ছে ঠিক যে সময়ে ললিত মোদির জন্য হলফনামা পেশ করতে বিলেত গিয়েছিলেন বসুন্ধরা, তখন একই সময়ে লন্ডনে ছিলেন বিজেপি-র আরও দুই নেতানেত্রী- নিতিন গডকড়ী ও স্মৃতি ইরানি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে মিথ্যা হলফনামা দেওয়ার অভিযোগে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রীর পদ থেকে স্মৃতি ইরানির ইস্তফার দাবিতে রাজধানীতে বৃহস্পতিবার তোলপাড় ফেলে কংগ্রেস ও আপ।

মহিলা কংগ্রেসের সমর্থকেরা বিজেপি সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখান তো আপ-এর মহিলা বাহিনী স্মৃতির বাড়ি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করেন। ক’দিন আগে একই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে দিল্লিতে আপ সরকারের আইনমন্ত্রী তোমরের গদি গিয়েছে এবং তিনি এখন গারদের মধ্যে রয়েছেন। তাই পাল্টা বিজেপি-রও উইকেট ফেলতে আপ আজ ৭২ ঘণ্টার চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তৃতীয়ত, পঙ্কজা মুণ্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ধুন্ধুমার শুরু হয়েছে মুম্বাইতেও। সর্বোপরি বৃহস্পতিবার আবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের বিরুদ্ধেও নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানিয়েছে কংগ্রেস। অভিযোগ হলো, রাজ্যসভা ভোটের সময় তার বিরুদ্ধে একটি এফআইআর-এর কথা হলফনামায় গোপন করেছিলেন পর্রীকর।

শুধু বাইরের এই ঝড় নয়। উথালপাথাল চলছে বিজেপি-র অন্দরেও। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিজেপি তথা সরকারের মধ্যে যে জরুরি অবস্থা তৈরি হয়েছে তা বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কথাতেই ধরা পড়েছে। নইলে স্মার্ট সিটি প্রকল্প আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু করার সম্মেলনে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে জরুরি অবস্থার কথা টেনে এনে তিনি বলতেন না, ‘‘চল্লিশ বছর আগে এমন দিনে স্রেফ ক্ষমতার সুখের জন্য জরুরি অবস্থা প্রয়োগ করে গোটা দেশকে জেলখানা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খবরের কাগজে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। রেডিও তাই বলত যা সরকার বলতে চাইত।’’ বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক তর্কের মুখ ঘোরাতে মরিয়া। কিন্তু চল্লিশ বছরের পুরনো একটি ঘটনা দিয়ে কি বর্তমান কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ চাপা দেওয়া যাবে! তা হলে?

মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারির এই অভিযোগ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কি নীরব থাকবেন এবং ইস্তফার দাবি থেকে মুখ ফিরিয়ে বিতর্ক ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন? নাকি সত্যিই এ বার অন্তত ইস্তফা দিতে বলা হবে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে?

বিজেপি সূত্রের মতে, এ ব্যাপারে একেবারেই দোটানায় রয়েছেন দল ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব! মোদি-অমিত শাহরা বুঝতে পারছেন বসুন্ধরা রাজে-র বিরুদ্ধে অভিযোগ অকাট্য। কিন্তু একবার বসুন্ধরাকে ইস্তফা দিতে বলা মানেই পরক্ষণে কংগ্রেস ও বিরোধীরা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে সুষমা স্বরাজকে অপসারণের জন্য চাপ বাড়াবে। তারপর স্মৃতি ইরানি, পঙ্কজা মুণ্ডের জন্য চাপ বাড়বে। বিজেপি-র আশঙ্কা, আইনি দিক থেকে বসুন্ধরা বা সুষমা-র বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হোক বা না হোক, কেউ একজন ইস্তফা দিলেই দুর্নীতির চিরন্তন দাগ লেগে যাবে শাসক দলের ওপর। কেননা, বর্তমান ভারতীয় রাজনৈতিক দর্শনে নৈতিক দায় নিয়ে ইস্তফার ব্যাপারটা একেবারে অর্থহীন। ইস্তফা দেওয়া মানেই তিনি দোষী। আর সেই বার্তাই গেলে দুর্নীতির প্রশ্নে মোদির রাজনীতির পুঁজিই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাবে। তবে এটা হলো সমস্যার একটা পিঠ মাত্র। অন্য পিঠ হলো, বসুন্ধরা বা সুষমার বিরুদ্ধে কিছু একটা ব্যবস্থা না নিলে সংসদের বর্ষা অধিবেশন চালানো মুশকিল হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিহার নির্বাচনও আসন্ন। তার আগে বিজেপি-র মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে যে ভাবে রোজ কাটাছেঁড়া হচ্ছে তাতেও ভাবমূর্তি মলিন হচ্ছে। বিদেশ সফর সেরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন। সূত্রের খবর, দলের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করতে বৃহস্পতিবার রাতে জেটলির সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী।

অন্য দিকে, বসুন্ধরা শিবিরও তাদের প্রতিরক্ষার কৌশল কিছুটা বদলেছে। প্রকাশ্যে না বললেও, বসুন্ধরা শিবিরের তরফে বৃহস্পতিবার বলা হয়, ললিত মোদির সমর্থনে হলফনামায় তিনি সই করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা নিছক বন্ধু হিসাবে, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হিসাবে নয়। তাই এটা কোনো অপরাধ নয়!

সামগ্রিক এই অবস্থায় আচমকা লটারি পেয়ে যাওয়ার মতোই অবস্থা এখন কংগ্রেসের। দলের এক শীর্ষ নেতা বৃহস্পতিবার বলেন, অভিযোগ ওঠা মাত্রই বিজেপি যে মন্ত্রীদের ইস্তফা দিতে বলবে সেই আশা কংগ্রেসও করেনি। বরং ইস্তফা দেওয়া নিয়ে যত বিলম্ব তত দিন বিজেপি-র বিরুদ্ধে কাদা ছেটানোর সুযোগ থাকবে। বিশেষ করে স্বচ্ছ প্রশাসন কায়েম করা নিয়ে মোদির ফোলানো বেলুনটাও চুপসে দেওয়া যাবে। ঠারেঠোরে এ কথাটাই বুঝিয়ে রাজস্থানের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা তরুণ কংগ্রেস নেতা শচিন পাইলট বৃহস্পতিবার ললিত মোদির হলফনামাটি প্রকাশ করেন। ওই হলফনামায় সাক্ষী হিসাবে তিন জনের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম ব্যক্তি হলেন মোদির ভারতীয় কৌঁসুলি মহমুদ আবদি। দ্বিতীয় স্থানে বসুন্ধরা আর তৃতীয় স্থানে রয়েছেন রবার্ট নিকোলাস নামে এক পেশাদারের নাম।

হলফনামার মাধ্যমে বৃটিশ প্রশাসনকে মোদি এ-ও জানিয়েছেন, ‘‘রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে আমার সখ্য এবং তাকে যেভাবে সাহায্য করেছি তাতেই কংগ্রেস অখুশি।’’ তার কথায়, ‘‘আমাকে বিপাকে ফেলে বসুন্ধরাকে চাপে ফেলতে চাইছে কংগ্রেস।’’

মোদির হলফনামাটি প্রকাশের পর শচিন জানান, বসুন্ধরা ইস্তফা না দিলে শুক্রবার থেকে রাজস্থানে লাগাতার আন্দোলন চলবে। তার কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে-পরে মোদিজি বার বার প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও পারদর্শিতার কথা বলতেন। তা কায়েম করার সাহস এখন কেন দেখাতে পারছেন না তিনি? বসুন্ধরা যা করেছেন, তা কোনো সাধারণ মানুষ করলে এত ক্ষণে পুলিশ কোমরে দঁড়ি বেঁধে নিয়ে যেত। তা হলে কি সাধারণ মানুষের জন্য এক আইন আর বিজেপি-র মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের জন্য পৃথক আইন? এখনও চার বছর সরকার চালাতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি কি সেটা ভুলে যাচ্ছেন!’’