বিএনপির সাথে সম্পর্ক: আলোচনা -সমালোচনা আমলে নিচ্ছে না জামায়াত

SHARE

jamat‘বিএনপির সাথে সম্পর্ক: আলোচনা -সমালোচনা  আমলে নিচ্ছে না জামায়াত’- এই শিরোনামে নয়া দিগন্ত পত্রিকা একটি প্রতিবেদন ছেপেছে আজ।পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণেও এটি রয়েছে।

গত বেশ কিছুদিন ধরেই বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন করেছে দেশের মিডিয়া। বিএনপির কয়েকজন নেতাও এই নি্য়ে মুখ খুলেছেন। ধরে নেয়া এ সবের পরিপ্রেক্ষিতেই নয়া দিগন্ত এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।প্রতিবেদনটিতে মূলত েএই বিষয়ে জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গী কী- সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।

নয়া দিগন্ত পত্রিকাটি জামায়াতের নয়, তবে জামায়াতের লোকজন এটি প্রকাশ করেছে। এই পত্রিকার মূল ব্যক্তি ছিলেন মীর কাসেম আলী, যিনি এখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি।

এখানে নয়া দিগন্তের প্রতিবেদনটি দেয়া হলো:

ইসলামপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত থাকলেও বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না জামায়াত। বিএনপির সাথে জামায়াতের যোগাযোগ ও সম্পর্ক আগের মতোই অটুট রয়েছে এবং এ সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কোনো লক্ষণ এবং যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে করছে না দলটি। জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপির অভ্যন্তরে ভিন্নমত থাকতেই পারে এবং এ নিয়ে জামায়াতের চিন্তিত বা বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলেও মনে করেন জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা মনে করছেন, বিএনপি, জামায়াতসহ ২০ দলীয় ঐক্যজোট একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের জোট এবং প্রত্যেকের আলাদা রাজনৈতিক আদর্শ রয়েছে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায় এবং দেশকে আবার গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনাই এখন জোটের প্রধান লক্ষ্য। সরকারের মারমুখো আচরণ ও নানা কৌশল মোকাবেলা করে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনই এখনো যেখানে মুখ্য বিষয় সেখানে জোট ভেঙে, কাউকে জোট থেকে বের করে দিয়ে ঐক্য বিনষ্ট করার মতো কোনো চিন্তা জোটের প্রধান শরিক বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে নেই বলেই মনে করেন জামায়াত নেতারা।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে জামায়াতের সাথে বিএনপির যোগাযোগের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তবে নির্বাচনের ঠিক আগে যোগাযোগের সেই দূরত্ব ঘুচে যায় এবং জোটের অন্যতম প্রধান শরিক হিসেবে বিএনপির সাথে জামায়াতের যোগাযোগ আগের মতোই রয়েছে। রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহেই ইফতার মাহফিলে জোটের শীর্ষ নেতাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটের ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর, মোদি-খালেদা বৈঠক এবং এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জামায়াতকে জড়িয়ে নানা খবর প্রকাশ, সর্বশেষ জামায়াত ও বিএনপির সম্পর্কের ব্যাপারে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করেই জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, পত্রপত্রিকায় যে যার মতো করে লিখছে। এগুলোর সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বিএনপির মধ্যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এগুলো আমাদের দেখার বিষয় নয়। বিএনপির সাথে জামায়াতের যোগাযোগ আগে যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবে আছে।

তিনি বিস্তারিত না জানিয়ে বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সবাই বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন।

জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অপর এক নেতার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার এ উপদেশ তো সরকারি দলের নেতারা অনেক আগ থেকেই দিয়ে আসছেন। এখন কেউ বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী সেজে একই উপদেশ দিলে সেটা কার স্বার্থে কী উদ্দেশ্যে দিয়েছেন তিনিই সেটা বলতে পারবেন। জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ আছে মর্মে যেসব তথ্য কোনো কোনো খবরে এসেছে সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। জঙ্গিবাদ আর জামায়াতকে এক করে দেখার চেষ্টা বছরের পর বছর চলেছে। কিন্তু সেটা কি কেউ প্রমাণ করতে পেরেছে? দেশ-বিদেশে সবার কাছেই জামায়াতের রাজনীতি পরিষ্কার। জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল-এটা দেশ-বিদেশে প্রমাণিত।

তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে জামায়াতকে অনেকটা অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করে রেখেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ও মহানগর অফিস থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অফিস পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে নেতারা কোনো সভা সমাবেশ ও চলাচল করতে পারছেন না। শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার করে একের পর এক সাজা দেয়া হচ্ছে, রায় কার্যকরও করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার জন্য নানা উদ্যোগের খবর প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ায় জামায়াতের বিরুদ্ধে একতরফা বিরূপ প্রচারণা চালানো হচ্ছে। জামায়াত তো কোথাও আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ পাচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা একাধিকবার করে জেল খেটেছেন এবং প্রতিনিয়ত গ্রেফতার হচ্ছেন। এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জামায়াত জোটের আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। আবার সাংগঠনিক তৎপরতাও আগের আঙ্গিকে না হলেও কৌশলে সব কর্মসূচিই পালন করে আসছে।

তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীদের বিজয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, এত বৈরী পরিবেশের মধ্যেও জামায়াতকে মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। এতেই প্রমাণিত হয় জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সঠিক পথেই আছে এবং সরকারের বৈরী আচরণ জামায়াতকে আরো গণমুখী দলে পরিণত করছে। জামায়াতের অন্য সূত্রগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেছে, মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় শীর্ষ দুই নেতার ফাঁসি কার্যকরসহ অন্যান্য নেতার বিচার দ্রুত শেষ করার বিষয়কে জামায়াত আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখছে।

সর্বশেষ দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় আপিল বিভাগে বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার ঘটনার সাথে নানা হিসাব-নিকাশ মিলাচ্ছে জামায়াত। সূত্র মতে, জামায়াত সব পরিস্থিতি নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মোকাবেলা করে দলকে ইসলামি আন্দোলনের ধারায় এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বিকল্প কৌশল ও প্রস্তুতি নিয়েই সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তবে জামায়াতের নেতারা রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশের কারণে কেউই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। তারা বলছেন, সরকার বা সরকারি সংস্থা যখনই জামায়াতের আগাম কোনো কর্মকৌশল জানতে পারছে সেটাই বানচাল করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। ফলে জামায়াতকে এসব ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।

জামায়াত সূত্র জানায়, জামায়াত অতি সম্প্রতিও রাজধানীতেই বিশেষ নামে একটি সাংগঠনিক পক্ষ পালন করেছে। এ ছাড়া সারা দেশে অন্যান্য নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। রমজান মাসেও ইফতার মাহফিলসহ নানা কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে।

এ দিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যাপারে জামায়াতের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা বিরাজ করলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা আন্দোলনকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তারা বলছেন, বর্তমান সরকার কিভাবে ক্ষমতায় এসেছে এবং কিভাবে ক্ষমতায় টিকে আছে এটা এখন আর সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করারও কোনো প্রয়োজন পড়ছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন এখন শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও। তাদের মতে, দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারকে সরকার কিভাবে খর্ব করে রেখেছে তা দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার। মানুষ সরকারের এ আচরণ এবং মনোভাবকে কোনোভাবেই সমর্থন করছে না। দেশ -বিদেশের কেউই দেশের অবস্থাকে স্বাভাবিক বলে মনে করছে না। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন এবং আন্দোলন দমনে সরকারের নানা কর্মকৌশলের কারণেই মূলত মানুষের কাছে বিষয়গুলো একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে জামায়াতের কর্মপরিষদের এক সদস্য বলেন, যারা বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থতার অভিযোগ করেন তাদেরকে একটু জিজ্ঞেস করুন, এভাবে অতীতে রাজপথে আন্দোলন দমনের কোনো নজির আছে কি? রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে সরাসরি গুলি করে মানুষ মারা, রাজনৈতিক নেতাদের কথায় কথায় মামলায় জড়িয়ে গণহারে গ্রেফতার করাসহ, অপহরণ, গুমের এমন নজির কি আছে? ওই নেতা বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণের যে ধারা এ সরকার চালু করেছে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত খারাপ নজির হয়ে থাকবে। এই পরিস্থিতির উত্তরণ এবং সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ দেশে ফিরে আসুক- এমনটি এখন দেশের প্রতিটি নাগরিকের একমাত্র কাম্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং জনসম্পৃক্ত ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই সেটা অবশ্যই ফিরে আসবে বলে এ নেতা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।