বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের পরিধি বেড়ে চলেছে। আর এরই অংশ হিসাবে সুন্দরবনের মূল ভূ-খণ্ড থেকে প্রায় শত কিলোমিটার উত্তরে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের সীমানা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীর বিস্তীর্ণ চর ও আশপাশের ১০-১৫টি গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে নতুন মিনি সুন্দরবন।
যদিও বাঘ-হরিণের উপস্থিতি এখানে নেই, তবে সুন্দরী, গোলপাতা, কেওড়া, ওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ভরপুর। এছাড়া অসংখ্য প্রকার সুন্দরবনের উদ্ভিদ জন্মেছে এখানে।
দিন দিন এর ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। এতে একদিকে যেমন গ্রামবাসীর মধ্যে আশার আলো দেখা দিয়েছে অন্যদিকে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার সীমানা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীর আশপাশের রায়গ্রাম, শুরিগাঁতী, খিলিগাঁতী, করাতদিয়া, ডুমুরিয়া, আড়ুলিয়া, খড়িয়াসহ গ্রায় ১০-১৫টি গ্রাম ও নদীর বিস্তীর্ণ চরজুড়ে এখন ‘নব্য সুন্দরবন’ গড়ে উঠেছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এসব গ্রাম বনাঞ্চলে পরিণত হয়েছে ।
এখানকার অধিকাংশ বাড়ির আঙিনাসহ আশপাশে আবাদি-অনাবাদি জমিতেও এখন গোলপাতা, কেওড়া, ওড়া, সুন্দরীসহ নানা প্রজাতির গাছ বেড়ে উঠছে। এছাড়া নদীর দু’কূল জুড়ে চিত্রা নদীর বিস্তীর্ণ চর এলাকায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে গাছের সংখ্যা। বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণীর দেখা না মিললেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অরণ্য। ঠিক যেন সুন্দরবনেরই একটা অংশ। বর্তমানে এলাকার লোকজন তাদের নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে হাজার হাজার টাকার গোলপাতা বিক্রি করছেন এখান থেকে।
এছাড়া জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় কাঠের চাহিদা মেটানো হচ্ছে এসব গাছ থেকে। পাশাপাশি এখানকার মনোরম দৃশ্য মুগ্ধ করছে অনেককে। বর্তমানে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ পুরোপুরি রূপ নিয়েছে সুন্দরবনে। প্রকৃতির এক অপরূপ লীলা ভূমিতে পরিণত হচ্ছে এলাকাটি। যদিও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি এখানে এখনো তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি তবে এলাকার লোকজন অনায়াসে বাড়িতে বসে সুন্দরবনের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছেন।
এ অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ির আঙিনাসহ আশপাশে সুন্দরীসহ নানা প্রজাতির বনের গাছ জন্ম নেয়ায় আশার আলো দেখছেন লোকজন। তবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এভাবে বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও বিষধর সাপের উপদ্রব বেড়ে যেতে পারে বলে গ্রামবাসীদের মধ্যে এক প্রকার সংশয় দেখা দিয়েছে।
উপজেলার ডুমুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রকৃতিপ্রেমী হরেন্দ্র নাথ রানা তার অনুভূতি প্রকাশ করে জানান, এখন বাড়িতে বসে সুন্দরবনের দৃশ্য উপভোগ করতে পারছি। নদীর দুপাড়ে সবুজের হাতছানি কেবলই কাছে টানছে ।
উপজেলার করাতদিয়া গ্রামের চিত্রা নদীর পাড়ের বাসিন্দা প্রবীণ বিষ্ণুপদ অধিকারী জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদী পাড়ের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়। সুন্দরবন থেকে উঠে আসা বিভিন্ন নদী চিত্রা নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছের বীজ এসব নদীতে ভেসে সরাসরি এখানে চলে আসে। এসব বীজে মূলত আপনা থেকে গাছের জন্ম হচ্ছে।
এতে গ্রামগুলো দিন দিন বন-জঙ্গলে ঘিরে যাচ্ছে। অনেকটা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলেও উল্লেখ করেন। এখানকার দৃশ্য পাল্টে যাচ্ছে। এভাবে গাছপালা বাড়তে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর বসবাসের উপযোগী থাকবে না বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
চিতলমারী সদর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ নিজাম উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়ন ঘেঁষে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। এখানে নদীর পাড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রতি বছর প্লাবিত হয় অসংখ্য গ্রাম। আর এসব গ্রামেই বর্তমানে সুন্দরবনের নানা গাছপালা জন্ম নিয়েছে। সুন্দরবন থেকে উঠে আসা বিভিন্ন নদীর সাথে চিত্রা নদীর সংযোগ রয়েছে। যে কারণে নদীর মাধ্যমে সহজে এখানে বনাঞ্চল গড়ে উঠছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী উত্সাহ প্রকাশ করে জানান, যেহেতু সুন্দরবন দিন দিন ছোট হয়ে আসছে নতুন করে এ ধরনের বনাঞ্চল সৃষ্টি হওয়াটা খুবই আনন্দের সংবাদ।
যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চল এটি, এখানে সহজে বনের বিভিন্ন গাছপালা জন্মানোর সুযোগ রয়েছে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে নতুন করে সুন্দরবনের বিস্তৃতি ঘটতে পারে। কিন্তু এটি যথাযথভাবে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের।