মিয়ানমারে ভারতীয় অপারেশন কি নতুন সামরিক কৌশল?

SHARE

oparationভারতের সেনাবাহিনী মঙ্গলবার মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে যে বিশেষ অপারেশন চালিয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জঙ্গিকে মেরে ফেলেছে আর অন্তত দুটি শিবির ধ্বংস করেছে, তা নিয়ে বুধবার  সেদেশে শুরু হয়েছে বিশ্লেষণ। ক্ষমতাসীন বি জে পি আর নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশ দাবি করছে এই বিশেষ অপারেশনের মাধ্যমে একটা কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে সব দেশকেই যে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসীদের রুখতে সীমান্ত পেরতেও ভারতীয় সেনারা পিছপা হবে না। এই অংশের ইঙ্গিত পাকিস্তানের দিকেই।

বিশ্লেষকদের অন্য অংশের মতে এর আগেও বিদেশে অপারেশন চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী আর সর্বশেষ এই অপারেশন কখনই সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ রোখার জন্য এটা নতুন শক্তিশালী নীতির ফল নয়।

ভারতের সেনাবাহিনী দাবী করেছে যে তাদের প্যারাকমান্ডো আর ইনফ্যান্ট্রির সদস্যরা মঙ্গলবার ভোর রাত থেকে মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে একটা বিশেষ অপারেশন চালিয়ে নাগা জঙ্গি গোষ্ঠী এন এস সি এন খাপলাং আর তাদের সহযোগী আরও কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীর শিবির ধ্বংস করেছে আর অনেককে মেরেও ফেলেছে। ঠিক কতজন জঙ্গি নিহত হয়েছেন, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।

ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী বলছিলেন, “ভারত সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে বলেই এত বড় অপারেশন চালাতে পেরেছে সেনাবাহিনী। তারা নিজে থেকে কখনই এই অপারেশন চালিয়ে থাকতে পারে না।”

তার মতে, “এই অপারেশনের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই বিভিন্ন দেশকে একটা বার্তা দেয়া গেছে যে প্রয়োজন পড়লে বিদেশে গিয়েও সেনাবাহিনী জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাতে পারে। যেসব দেশের এই বার্তাটা বোঝা উচিত, আশা করা যায় তারা বুঝতে পারবে। তবে তার মানে এই নয় যে আবারও নিশ্চিতভাবেই এরকম অপারেশন চালানো হবে ভবিষ্যতে” বলছিলেন ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী।”

এটা পরিষ্কার যে এই অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের দিকেও একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে রাজনৈতিক মহল থেকে।

যদিও সেনাবাহিনী বলছে মনিপুরে গত চার তারিখে যেভাবে তাদের ২০ জন সদস্যকে হত্যা করেছে নাগা জঙ্গিরা, তার পরে এরকম প্রতিহিংসামূলক অপারেশন চালানো কিছুটা বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল। বিশ্লেষকদের একাংশ আবার এই অপারেশনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটাকেই বড় করে দেখছেন।

ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের কার্যনির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনী বলছিলেন, “এই অপারেশনের পরে সামরিক কৌশল নিয়ে আলোচনার থেকে বেশী দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক আস্ফালন। কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি’র সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই অপারেশনটাকে ভারতের একটা নতুন সামরিক নীতি হিসাবে দেখাতে চাইছেন।”

তিনি বলেন, “বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে সরকারের একটা শক্তিশালী নীতি, পেশীশক্তির প্রদর্শন হচ্ছে। কিন্তু এধরণের অপারেশন আগেও চোরাগোপ্তা হয়েছে আর মঙ্গলবারের অপারেশনটার প্রয়োজনীয়তা ছিল একটা স্থানীয় হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। এই অপারেশন থেকে কোনও বড়সড় কৌশলগত পরিবর্তন না হওয়ারই সম্ভাবনা।”

সাহনী আরও বলছিলেন যে একটা অপারেশনে সেনাবাহিনী বিজয়ী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিয়ানমারে অবস্থিত জঙ্গি শিবিরগুলি ধ্বংসের জন্য লাগাতার প্রচেষ্টা না থাকলে এই অপারেশনের কোনও গুরুত্বই থাকবে না।

প্রায় একই কথা বলছিলেন উত্তরপূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ও জঙ্গিতৎপরতার বিশ্লেষক রাজীব ভট্টাচার্যি। তিনি বলেন, “জঙ্গি শিবিরগুলি আদৌ ধ্বংস করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ৩০ বছরেরও বেশী সময় ধরে এই শিবিরগুলি গড়ে উঠেছে আর সেগুলোর সংখ্যা নিয়মিত বেড়েই চলেছে।”

তিনি বলেন, “ভারতের সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই এই শিবিরগুলো ধ্বংস করতে চাইবে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সুযোগ মিয়ানমার তাদের বারবার দেবে কি না। কারণ মিয়ানমার সরকার বা তাদের সেনাবাহিনী একটা নতুন ফ্রন্ট খুলে উত্তরপূর্বের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে চাইবে না।”

এ মাসের চার তারিখ মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে ৬ নম্বর ডোগরা রেজিমেন্টের সদস্যদের ওপরে হামলা হয়। রোজকার মতোই রোড ওপেনিং পেট্রল বা রাস্তার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখার জন্য সেনাবাহিনীর চারটি গাড়ি পারালং আর চারোং গ্রামের কাছে পৌঁছলে প্রথমে ভূমি মাইন ফাটানো হয়। তারপরেই রকেট ছোঁড়া হয় আর স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে চলতে থাকে গুলি বৃষ্টি।

ওই জায়গাটি ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে।এই হামলার প্রেক্ষিতেই মঙ্গলবারের সেনা অপারেশন। এই অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করার জন্যই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে যাননি। বাহিনীর ওপরে জঙ্গি হামলার পরেই মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলে সেনাপ্রধান দলবীর সিং সুহাগ মঙ্গলবারের অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। সূত্র: বিবিসি।