বছরজুড়ে ট্রাম্পের যত অস্বাভাবিক কাণ্ড

SHARE

হোয়াইট হাউস থেকে ডিসেম্বরে দেওয়া এক ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, গত ১১ মাসে তার প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যেকোনো সরকারের চেয়ে ‘আরো ইতিবাচক পরিবর্তন’ এনেছে।

ট্রাম্প আরো বলেন, ‘এমন কিছু আগে কখনো হয়নি।’

আংশিকভাবে তা সত্য যে তার দ্বিতীয় মেয়াদটি ব্যতিক্রমী। তবে সেই ব্যতিক্রমের অনেক দিকই এমন, যা হয়তো প্রেসিডেন্ট নিজে পছন্দ করবেন না।
কারণ ৭৯ বছর বয়সী ট্রাম্প ২০২৫ জুড়ে বারবার অনিয়মিত ও কখনো কখনো বিভ্রান্ত আচরণ করেছেন, যা তার মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

বিভিন্ন বৈঠকে ট্রাম্পকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখা গেছে। আবার অনেক সময় তিনি আলোচনার বিষয় ছেড়ে হঠাৎই অদ্ভুত প্রসঙ্গে ঢুকে পড়েছেন—কখনো অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, কখনো তিমি ও পাখির গল্প। তার প্রকাশ্য উপস্থিতিগুলোতে মনোযোগের ঘাটতি দেখা গেছে।
ভাষণে তিনি কখনো বারাক ওবামার সিঁড়ি দিয়ে নামার ভঙ্গি নিয়ে কথা বলেছেন, আবার কখনো ইউনাবোম্বারকে ঘিরে মনগড়া গল্প শুনিয়েছেন।

এই অনিশ্চিত আচরণের কারণে হোয়াইট হাউসকে বারবার ট্রাম্পের মানসিক সক্ষমতা নিয়ে সাফাই দিতে হয়েছে, অনেক সময় অতিরঞ্জিত ভাষায়। ট্রাম্প নিজে গর্ব করে বলেছেন, তিনি এমন এক পরীক্ষায় ‘দারুণভাবে পাশ’ করেছেন, যা ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ যাচাই করে। কিন্তু অফিসে থাকার ১১ মাসে তার অস্বাভাবিক আচরণের উদাহরণ জমতে জমতে পাহাড় হয়েছে।

এর মধ্যে জুলাইয়ের মাঝামাঝি একটি ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন ট্রাম্প বিস্তারিতভাবে বলেন, তার প্রয়াত কাকা অধ্যাপক জন ট্রাম্প নাকি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে টেড কাজিনস্কিকে পড়িয়েছিলেন—যিনি ইউনাবোম্বার নামে পরিচিত।

ট্রাম্প বলেন, “আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেমন ছাত্র ছিল সে, আঙ্কেল জন?’ তিনি বললেন, ‘খুব ভালো।’ তিনি নাকি সবার ভুল ঠিক করত।’ এরপর ট্রাম্প যোগ করেন, ‘কিন্তু তার জন্য শেষ পর্যন্ত ভালো হয়নি।
’”

সমস্যা হলো, এই গল্প সত্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রথমত, ট্রাম্পের কাকা মারা যান ১৯৮৫ সালে, আর কাজিনস্কিকে ইউনাবোম্বার হিসেবে শনাক্ত করা হয় ১৯৯৬ সালে। দ্বিতীয়ত, কাজিনস্কি এমআইটিতে পড়াশোনাই করেননি।

ওই মাসের শেষদিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েনের সঙ্গে বৈঠকে অভিবাসন নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎই ট্রাম্প ‘উইন্ডমিল’ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন। কোনো উসকানি ছাড়াই টানা দুই মিনিট তিনি দাবি করেন, এগুলো নাকি তিমিকে ‘পাগল’ করে দেয় এবং বায়ুশক্তি ‘পাখি মেরে ফেলে’—যদিও বাস্তবে টারবাইনে পাখির মৃত্যুর হার গৃহপালিত বিড়াল বা বিদ্যুৎ লাইনে ধাক্কা খেয়ে মরার তুলনায় নগণ্য।

সেপ্টেম্বরে আরেকটি ঘটনায় ট্রাম্পের মানসিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি ভার্জিনিয়ায় দেশের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের ডেকে এনে নিজের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমেরিকাকে আবার সম্মান করা হচ্ছে। বাইডেনের সময় তা ছিল না। ওরা তাকে প্রতিদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে দেখত।’

এরপর ট্রাম্প বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, এটা আমাদের প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। আমি খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামি। রেকর্ড গড়ার দরকার নেই, শুধু পড়ে যেও না। কয়েকজন প্রেসিডেন্ট পড়ে গেছেন, আর সেটাই তাদের উত্তরাধিকার হয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ওবামার সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার ভঙ্গি দেখে তার ‘শূন্য সম্মান’ ছিল, যদিও তিনি স্বীকার করেন, ওবামা সেটা ভালোভাবেই করতেন।

হোয়াইট হাউস বারবার ট্রাম্পের মানসিক সক্ষমতা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন নাকচ করেছে। এ বছরের শুরুতে এক মুখপাত্র বলেন, তার ‘মানসিক তীক্ষ্ণতা অতুলনীয়’। আর ট্রাম্পের সাবেক চিকিৎসক ও বর্তমানে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান রনি জ্যাকসন দাবি করেন, তিনি ‘এই দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুস্থ প্রেসিডেন্ট’।

তবু ট্রাম্পের স্বাস্থ্য নিয়ে জল্পনা থামার লক্ষণ নেই। ডেইলি বিস্ট জানিয়েছে, ডেমোক্র্যাটরা আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তার মানসিক সক্ষমতা ও সুস্থতাকে বড় ইস্যু করতে চায়।

তাদের হাতে যথেষ্ট উপকরণ আছে। নভেম্বরে ট্রাম্প জানান, তিনি এমআরআই করিয়েছেন, কিন্তু কোন অঙ্গের তা মনে করতে পারেননি। ওই মাসেই ওভাল অফিসের এক বৈঠকে তাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখা যায়—ডিসেম্বরে ক্যাবিনেট বৈঠক ও গাঁজা সংস্কার নিয়ে সংবাদ সম্মেলনেও একই ঘটনা ঘটে।

এর আগে, শান্তিচুক্তি প্রসঙ্গে তিনি আলবেনিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়াকে গুলিয়ে ফেলেন। অটিজম নিয়ে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘কিছু প্রতিভার উপাদান শিশুর মধ্যে দেওয়া হতে পারে’। ১৩টি গবেষণা অনুদান ঘোষণার সময় তিনি বলেন, ‘কিছু খারাপ হতে পারে না, শুধু ভালোই হতে পারে।’

এই বিভ্রান্তির মধ্যেই ট্রাম্প কখনো কখনো লাগামহীন আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন। শুধু ডিসেম্বরে তিনি সোমালি অভিবাসীদের ‘আবর্জনা’ বলেন এবং এমনকি রব রেইনারকে নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী করার মতো মন্তব্য করেন, যা অনেক রিপাবলিকানকেও চমকে দেয়।

এসবের মাঝেও ট্রাম্প তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত সময়সূচি বজায় রেখেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের হিসাবে, তার নির্ধারিত কর্মসূচি সাধারণত দুপুরের দিকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৫টার মধ্যে শেষ হয়—প্রথম মেয়াদের তুলনায় ছোট কর্মদিবস। তার আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি কমেছে ৩৯ শতাংশ।

হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রেসকে দেওয়া দৈনিক সূচিতে প্রেসিডেন্টের সব বৈঠক অন্তর্ভুক্ত থাকে না।

হোয়াইট হাউসের সহকারী প্রেস সচিব লিজ হাস্টন ইমেইলে বলেন, ‘দ্য গার্ডিয়ান একটি বামপন্থী মুখপত্র, এমন আবর্জনা প্রকাশ করে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। প্রেসিডেন্টের চিকিৎসক ড. শন বারবাবেলা বারবার পরিষ্কার করেছেন—এবং আমেরিকান জনগণ নিজের চোখেই দেখছে—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পূর্ণ সুস্থ।’

তিনি আরো বলেন, ট্রাম্পের ‘অদম্য কর্মস্পৃহা ও শক্তি’ আগের চার বছরে গণমাধ্যম যে ভাবে জো বাইডেনের মানসিক ও শারীরিক অবনতি আড়াল করেছিল, তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

নভেম্বরে পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক জাতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ওপর আস্থা রাখেন—যা মার্চ ২০২৫-এর তুলনায় ১১ পয়েন্ট কম এবং ২০১৬ সালের তুলনায় ২০ পয়েন্ট কম।

একই মাসে গ্যালাপের জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্পের কাজের প্রতি সমর্থন ৩৬ শতাংশ—দ্বিতীয় মেয়াদের সর্বনিম্ন। এর আগে ইউগভ দেখায়, অর্ধেক আমেরিকান মনে করেন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অতিরিক্ত বয়সী।

সারা বছর ধরেই হোয়াইট হাউস জোরালোভাবে ট্রাম্পকে রক্ষায় নেমেছে। তবে জুনে ৮০ বছরে পা দিতে যাওয়া ট্রাম্পকে ঘিরে প্রশ্ন যে সহজে থামবে না, সেটাই এখন স্পষ্ট।

সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান