বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন বানচালে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো থেমে নেই। তিনি বলেন, ‘শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনাটি নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের অংশ। যারা স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রকামী মানুষকে ভয় দেখাতে চায়, তারা ব্যর্থ হবেই। ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০ ও ২০২৪ সালের আন্দোলন প্রমাণ করেছে জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে বিজয় অনিবার্য।
নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।’ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিলে তিনি নিজেও থাকবেন বলে আশ্বাস দেন।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির ভার্চুয়াল বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহ উদ্দিন আহমদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, যুবদলের নুরুল ইসলাম নয়ন, স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজিব আহসান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের জনগণ সাক্ষী, কারণে-অকারণে শর্তের পর শর্ত জুড়ে দিয়ে কিংবা নানা অজুহাতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একটি চক্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে বারবার নানা রকম বিঘ্ন সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সব রকম বাধা উপেক্ষা করে প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় পর নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত জনগণের সেই আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখটি ঘোষণা করেছে।’
সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। গণতন্ত্রের পক্ষের সাহসী সন্তান ওসমান হাদিকে গুলির যে ঘটনা, এটা সেই ষড়যন্ত্রের অংশ।
কী ছিল ওসমান হাদির অপরাধ? একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার মনে যে প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছে, এই কয়েকটি প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই আমার মনে হয় এই ঘাতকদের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
তারেক রহমান বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যে প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছে, এক. বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বা সরকারকে যদি ব্যর্থ করা যায় তাহলে কারা খুশি হবে? দুই. নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বহাল রাখা গেলে কারা লাভবান হবে? তিন. দেশে জনগণের ভোটে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে কাদের লাভ? আমি বিশ্বাস করি, এসব প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই হাদির ঘাতকেরা লুকিয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শত্রুরা ঘাপটি মেরে রয়েছে এসব প্রশ্নের উত্তরে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘পতিত ও পলাতক একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের হীন ও দলীয় স্বার্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে। স্বাধীনতার ইতিহাসকে দলীয় ইতিহাসে পরিণত করার অপচেষ্টা অতীতেও হয়েছে, এখনো পরাজিত একটি চক্র বিজয়ের নতুন ইতিহাস রচনার চেষ্টা করছে।
এর বিপরীতে প্রতিশোধ নয়, বরং প্রতিটি মানুষের ঘরে বিজয়ের সুফল পৌঁছে দিয়ে একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়াই হোক এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি মনে করে, জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র টেকসই হবে না। দেশের ইতিহাসে যতবার গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে, ততবারই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে। জনগণকে ক্ষমতাহীন করে রাষ্ট্র কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। তাই জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। এ কারণেই দলটি সব সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।’
তারেক রহমান আরো বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি নির্বাচন নয়। এটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ, দেশের সার্বভৌমত্ব ও আগামী দশকের রূপান্তরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নারী, তরুণ, কৃষক-শ্রমিকসহ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে একটি স্বনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই বিএনপির লক্ষ্য।’
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে তিনি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান এবং শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি বলেন, ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিন আমাদের মহান বিজয় দিবস। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে কখনোই এই দিবসের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য মলিন হবে না। তবে একটি বিষয় আমাদের সবার স্মরণে রাখা দরকার, সতর্ক থাকা দরকার। সেটি হলো, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশিবিদেশি অপশক্তি তখনো যেমন সক্রিয় ছিল এখনো সক্রিয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের রং-রূপ-চেহারা হয়তো পাল্টেছে, চরিত্র কিন্তু পাল্টায়নি।’
তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ হঠাৎ করেই সাগরের বুকে ভেসে ওঠা কোনো ভূখণ্ড নয়। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ আর অসংখ্য মা-বোনের সম্মান সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডটির স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে অসংখ্য গল্প, বই, কবিতা রচিত হয়েছে। অনেকেই হয়তো জানেন, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধ রয়েছে। এই নিবন্ধটি আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনন্য দলিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রে জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যাবে না তত দিন পর্যন্ত স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে না।’
তিনি বলেন, “আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেবল ‘এক্সপেরিমেন্ট আর এক্সপেরিয়েন্স’ অর্জনের নির্বাচন নয়। এই নির্বাচন অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, চার কোটির বেশি তরুণ, কোটি কোটি কৃষক-শ্রমিক, কর্মক্ষম এই জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশের বিজয়কে সুসংহত করাই বিএনপির লক্ষ্য। একটি স্বনির্ভর-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমার-আমাদের আগামীর প্রতিটি বিজয় দিবসকে আরো গৌরবান্বিত এবং আরো অর্থবহ করে তুলতে চাই।”
মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তিনি দলমত-ধর্মবর্ণনির্বিশেষে কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আলেম ওলামা-পীর মাশায়েখ তথা বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ/প্রতিটি নাগরিককে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘বিজয়’ বার্তাকে শুধু উদ্দীপ্ত স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে বিজয়ের সুফল প্রতিটি নাগরিকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি আবারও জনগণের সহযোগিতা সমর্থন এবং সুযোগ প্রত্যাশা করছে।
সবশেষে তিনি আল্লাহর দরবারে একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে শহীদ এবং চব্বিশে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে শহীদ এবং একাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শহীদদের রুহের মাগফিরাত এবং আল্লাহর দরবারে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে হতাহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।
একাত্তরের অপশক্তির এজেন্টরা স্বাধীনতা বিপন্নের চক্রান্ত-জাল বুনে চলেছে : মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, একাত্তরে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হলেও চক্রান্তকারীদের নীলনকশা এখনো চলমান। তিনি বলেন, আগ্রাসি শক্তি আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অবজ্ঞা করার ঔদ্ধত্য দেখায়। ওই অপশক্তির এ দেশীয় এজেন্টরা আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা বিপন্ন করার চক্রান্তজাল বুনে চলেছে।
দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পরে জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। এই দিনে স্বাধীনতাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের জানান গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। বিদেশি শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে যেসব মা-বোন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানান।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধ ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়, পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে। দেশের অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে এ বিজয় ছিনিয়ে আনেন। তাই ১৬ ডিসেম্বর জাতির অহংকার, আনন্দ আর বেদনার এক মহাকাব্যিক দিন।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রহীন দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দাপটে সর্বত্র হতাশা, ভয় আর নৈরাজ্যের অন্ধকার নেমে আসে। ক্ষমতা জবরদখলকারীরা জনগণের ওপর নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে অদৃশ্য ও হত্যা করে এবং মানুষকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করে। পরিস্থিতি ভয়ংকর নৈরাজ্যময় হয়ে ওঠে। তিনি আরো বলেন, যিনি জীবনের দীর্ঘ সময় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন সেই অবিসংবাদিত নেত্রীকে অন্যায়ভাবে বন্দি করে অন্ধকার কারাগারে রাখা হয়েছিল। অমানবিক নিপীড়ক শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা চিরস্থায়ীভাবে ধরে রাখার জন্য একের পর এক গণবিরোধী পদক্ষেপ নিতে থাকে।
লন্ডনে আজ তারেক রহমানের জনসভা : যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফেরা সামনে রেখে আজ লন্ডনে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি। সম্ভবত এটি হতে যাচ্ছে তাঁর দেশে ফেরার আগে লন্ডনে সর্বশেষ জনসভা।
জানা গেছে, বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার পূর্ব লন্ডনের সিটি প্যাভিলিয়ন হলে অনুষ্ঠিত হবে এই জনসভা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন তারেক রহমান। সভাপতিত্ব করবেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ। এম এ মালিক তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে পোস্ট করে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৫টায় পূর্ব লন্ডনের সিটি প্যাভিলিয়ন হলে যুক্তরাজ্য বিএনপির উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। উল্লেখ্য ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর গ্রেপ্তার হন তারেক রহমান। ২০০৮ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান। এরপর থেকে যুক্তরাজ্যেই আছেন তিনি।




