ভিলাটা অল্প কিছুদিন আগেই মাত্র উৎসবের রংয়ে রাঙানো হয়েছে। প্রতিটি ঘরে রঙিন মোমবাতি আর পাহাড়ি ফুল দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো ভিলাটিকে দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন কোনো পাহাড়ি অর্কিড গাছের ফুল। এখন শুধু অপেক্ষা কোনো এক ধণী পরিবার এসে এই ভিলাটিতে অবস্থান করে মানুষের শূণ্যতা পূরণ করা। হ্যা, পাঠক আমরা বর্ননা দিচ্ছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফাগনিস্তানের বিখ্যাত কাবুল শহরে অবস্থিত বেভারলি হিলসের। দীর্ঘ পাহাড়ের উপরে মনোরম পরিবেশে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো সকল সৌন্দর্য্য নিয়ে দাড়িয়ে থাকা বেভারলি হিলস।
যুদ্ধাবস্থার ভেতর দিয়ে যাওয়া আফগানিস্তানে বাহিরের দেশ থেকে কোনো পর্যটক আসবে না এটাই স্বাভাবিক। তবে কেন এই ভিলা তৈরি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আপনাকে জানতে হবে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে থাকার পরেও আফগানিস্তান থেকে পপি চাষ বন্ধ করা যায়নি। ২০০৪-০৬ সালের দিকে পপি চাষ বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল আফগান প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু ২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে আবারও পপি চাষ বেড়ে যায় আফগানিস্তানে। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী আফগানিস্তান আবারও পপি উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এই পপির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ধনীদের মনোরঞ্জন এবং ব্যবসায়িক কাজের জন্যই ব্যবহৃত হয় বেভারলি হিলস।
কাবুলের যে অঞ্চলে এই ভিলাটি অবস্থিত তার চারপাশেই বিভিন্ন যুদ্ধবাজ গোষ্ঠির বসবাস। তাই হাজার চেষ্টা করেও আফগান প্রশাসনের পক্ষে এই অঞ্চলে কোনো প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্যানুসারে, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের শাসন শুরু হওয়ার পরেই মূলত বেভারলি হিলস তৈরি হয়েছে। বিদেশি কন্ট্রাকটর, দাতা গোষ্ঠি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক কোম্পানিগুলোর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা কাবুলে আসলে বেভারলি হিলসে তাদের আপ্যায়ন করা হতো। গোটা আফগানিস্তানে যে বিলাস সুবিধা পাওয়া যায় না, তা বেভারলি হিলসে পাওয়া যায়। যে কারণে অনেক মার্কিন কর্মকর্তাদেরও বিভিন্ন সময় ওই ভিলায় অবস্থান করতে দেখা গেছে। অবশ্য এই ভিলাতে তারা মুফতে থাকতেন না, প্রতি মাসের জন্য ২৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডলার পর্যন্ত গুনতে হয় তাদের।
আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনী কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই তালেবানদের তৎপরতা বেড়ে যায়। সর্বশেষ ওবামা প্রশাসন আরও এক বছর আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী অবস্থানের নির্দেশ দিলে তালেবানরা নতুন করে দেশটির কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। যে অঞ্চলগুলোতে মূলত পপি চাষ হয়, সেই অঞ্চলগুলোকেই অর্থের জন্য প্রাথমিক লক্ষ্যস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে তালেবানরা। বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়ে পপির ফসল উঠানোর সময় হলে চাষিদের কাছ থেকে ফসল কিনে নেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে মাদকব্যবসায়িরা আসে। এদের মধ্যে অনেকেরই স্থান হয় ওই বেভারলি হিলসে।
আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা এএফপি’র পক্ষে কিছুদিন আগে সম্ভব হয় বেভারলি হিলসে ঢোকার। সেখানে জমির এজেন্ট আবদুল লতিফের সঙ্গে কথা হয় তাদের। আবদুল হালিমই জানান যে, বর্তমানে বেভারলি হিলসের মন্দাবস্থা যাচ্ছে, তবে সামনেই যে এই মন্দাবস্থা থাকবে না এই ইঙ্গিতও তার বক্তব্যে পাওয়া যায়। এএফপি’র বর্ননা মতে, পুরো ভিলাটিকে মনে হচ্ছিল যেন একটি বিশাল গোলাপ ফুল।
ভিলাটি সম্পর্কে আবদুল লতিফ আরও বলেছিলেন যে, কোনো প্রকার বোমা কিংবা গুলি থেকে রক্ষার জন্য ভিলার কক্ষগুলোকে ব্লাস্টপ্রুফ করে তৈরি করা হয়েছে। যাতে এর ভেতরে থাকা ধনী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের কোনো ক্ষতি না হয়। তবে চলতি বছরে আফগানিস্তানে যাদের হাতে বিপুল পরিমান অর্থ আছে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলেও জানান আবদুল লতিফ।
পুরো আফগানিস্তানে এরকম আরও কয়েকটি ভিলা আছে। কিন্তু এই ভিলাগুলোর সত্যিকারের মালিকের সন্ধান পাওয়া যায় না। কিছু সূত্র জানায় যে এই ভিলাগুলো স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতাদের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। আবার এটাও শোনা যায় যে, ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়িরাই স্থানীয়দের দিয়ে এই ভিলাগুলো তৈরি করিয়েছে। যাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের কারণে অগুনতি মানুষের বিপুল পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, পাশাপাশি একটি শ্রেণি ফুলে ফেপে উঠেছে রাতারাতি। যুদ্ধের বাজারের এই নিয়ম চলছে বর্তমান পুঁজি কেন্দ্রিক সময়ে। জার্মানি, জাপান, ভারত, বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশেই এই চিত্র আমরা দেখতে পাই। কুৎসিত বাণিজ্যের কাছে হেরে যাচ্ছে প্রাচ্যের পাহাড়ি গোলাপের উদ্যান।