✍️ ইমারত হোসেন
সম্পাদক, 24hourbd.com
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু গণআন্দোলন ও সংগ্রামের অধ্যায় রয়েছে। তবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান ছিলো এক অনন্য মাইলফলক, যা শুধু একটি প্রজন্মের চেতনায় নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথে গভীর ছাপ ফেলেছে। এ অভ্যুত্থান ছিল স্বৈরশাসন, ভোটবিহীন নির্বাচন, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ—যেখানে মানুষ দল-মত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমেছিল।
⸻
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের কারণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। “ডামি” বা প্রহসনের নির্বাচন বলে আখ্যায়িত ওই নির্বাচনের পর সরকার যখন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে, তখন শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, সাধারণ মানুষ—সবাই ধীরে ধীরে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে।
জুলাই মাসে ছাত্রদের সংগঠিত আন্দোলন, পেশাজীবীদের নৈতিক সমর্থন, গণমাধ্যমে সোচ্চার প্রতিবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার ফলে এই অভ্যুত্থান রূপ নেয় একটি জাতীয় আন্দোলনে।
⸻
আন্দোলনের ধরণ ও বিস্তার
এই গণঅভ্যুত্থান ছিলো মূলত বেসামরিক এবং অহিংস। দেশের সব বড় শহর—ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও রংপুরে একযোগে বিক্ষোভ হয়।
প্রথম দিকে এটি ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তবে খুব দ্রুত এটি শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যাংকার, সাংবাদিক, নারী ও তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে রূপ নেয়।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, এমনকি কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা পর্যন্ত আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। রাজপথে অবস্থান কর্মসূচি, “নির্বাচন চাই” স্লোগান, কালো পতাকা মিছিল ও প্রতীকী অনশন এই আন্দোলনের মূল কৌশল ছিল।
⸻
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও দমননীতি
সরকার প্রথমদিকে আন্দোলনকে উপেক্ষা করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কঠোর অবস্থান নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভ দমন করতে অত্যধিক বলপ্রয়োগ, গ্রেপ্তার ও হামলা চালায়। অনেক জায়গায় সাংবাদিকদেরও নিপীড়নের শিকার হতে হয়।
তবে দমননীতি ব্যর্থ হয়। বরং শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ। জনগণের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সরকারের উপর চাপ তৈরি করে।
⸻
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে কভার করে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু রাষ্ট্র July Uprising-এর ঘটনাবলিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানায়।
⸻
ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলেছে। তরুণ সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা আর কেবল ভোটের দিন নয়, সব সময় রাজনীতির অংশ।
গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ নয়—তা প্রতিদিনের চর্চা। এই অভ্যুত্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র ক্ষমতা সর্বদা জনগণের হাতে, এবং জনগণ চাইলে তা ফিরিয়ে আনতে পারে।
⸻
উপসংহার
জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোনো একদিনের ঘটনা নয়, এটি ছিলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন, সংঘবদ্ধ এবং গণতন্ত্রমুখী। ইতিহাস সাক্ষী থাকবে, ২০২৪ সালের জুলাই ছিলো গণতন্ত্রের দাবিতে সাধারণ মানুষের এক নতুন জাগরণ।