বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর এই তিন দেশের সমন্বয়ে ‘একটি সম্ভাব্য জোট’ গঠনের সম্ভাবনা সামনে এসেছে। তিন দেশের মধ্যে এটিই এ ধরনের প্রথম বৈঠক। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই তিনটি দেশের মধ্যে একমত হওয়া বিষয়গুলো তদারকের জন্য শিগগিরই একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করা হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মূলত চীনের উদ্যোগেই এ বৈঠকটি হয়েছে, যাকে তিন দেশই ‘অনানুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং এ বৈঠকে ‘সম্ভাব্য ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা’র বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার চীনের কুনমিং-এ নবম চায়না-সাউথ এশিয়ান এক্সপজিশন অ্যান্ড দ্যা সিক্সথ চায়না-সাউথ এশিয়া কো-অপারেশন- শীর্ষক বৈঠকের সাইডলাইনে তিন দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এ বৈঠকের খবর বিশ্লেষকদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেছে। বিশেষ করে আর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এমন উদ্যোগে সামিল হচ্ছে সেই প্রশ্নও উঠছে।
যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক ও বিশ্লেষক ওবায়দুল হক বলছেন, রাজনৈতিক সরকারগুলোর পক্ষে এ অঞ্চলে ভারতকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে আরেকটি জোটের দিকে অগ্রসর হওয়া কঠিন হবে এবং সে কারণেই চীন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টাকেই এ উদ্যোগের জন্য বেছে নিয়ে থাকতে পারে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন, এ উদ্যোগের পেছনে ভারতকে একটা ‘বার্তা’ দেওয়ার চেষ্টা থাকতে পারে। তবে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা, এই তিন দেশ শেষপর্যন্ত কীভাবে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, সেটাই হবে দেখার বিষয়।
প্রসঙ্গত, চীন সরকারিভাবে নানা উদ্যোগের পাশাপাশি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
এদিকে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল আজ রবিবার রাতে চীন সফরে যাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে সম্পর্ক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে কী জানা যাচ্ছে
চীনের কুনমিংয়ে ওই বৈঠকে চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইডং, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী ও পাকিস্তানের অতিরিক্ত সচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ ভার্চুয়ালি এতে অংশ নিয়েছেন।
বৈঠকের পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে ‘প্রতিবেশীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি, সমতা ও পারস্পরিক বিশ্বাস, উন্মুক্ততা ও অন্তর্ভুক্তি, অভিন্ন উন্নয়ন ও সবার সুফলের সহযোগিতা’ নীতির ভিত্তিতে সহযোগিতার জন্য তিন পক্ষের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে দেওয়া বিবৃতিতে বৈঠকটিকে ‘অনানুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, বৈঠকে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান আঞ্চলিক শান্তি, উন্নতি ও স্থিতিশীলতার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সম্ভাব্য ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়, বৈঠকে সহযোগিতা আরো শক্তিশালী করতে কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে অবকাঠামো, যোগাযোগ, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, ম্যারিটাইম অ্যাফেয়ার্স, তথ্য প্রযুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন।
পাকিস্তান ও চীনও আলাদা করে বৈঠকের বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে। চীনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান চীনের ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু ও ভালো অংশীদার এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।’
বিবৃতিগুলোয় তিন দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কাজ করতে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরির সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
আলোচনা ও নানা প্রশ্ন
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে চীনের ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার উদ্যোগ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কে কেন বেছে নেওয়া হলো, সেই প্রশ্নও উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, এ ধরনের একটি কৌশলগত জোটে সম্পৃক্ত হওয়ার ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি-না। এছাড়া এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো ফোরামে আলোচনা হয়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত, যেখানে যথাযথ বাছাই ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে পারে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার এলে ভারতকে এভাবে পাশ কাটিয়ে চীন ও পাকিস্তানের সাথে জোট করা সহজ হবে না।
‘চীনের দিক থেকে বিবেচনা করলে অন্তর্বর্তী সরকারটাই তার জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ রাজনৈতিক সরকারকে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হয়, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হয় না। এ জন্যই হয়তো চীন এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে,’ বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ওবায়দুল হক।
যদিও গত বছরের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। অন্যদিকে ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে ঢাকায় বৈঠক হয়েছে প্রায় পনের বছর পর।
আবার চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই স্থিতিশীল। দেশটি এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। আবার সেই সরকারের পতনের পর বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীনে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরেও দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন, চীন ও পাকিস্তান আগে থেকেই পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে একযোগে কাজ করছে। ‘এখন সেসব বিষয়ে বাংলাদেশ কীভাবে যুক্ত হতে পারে এবং তাতে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হবে, সেটি দেখার একটি চেষ্টা এই পদক্ষেপে বাংলাদেশের দিক থেকে থাকতে পারে।’
যদিও তার মতে, চীন ও পাকিস্তানের সাথে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতার সম্পর্ক হলেও বাংলাদেশের জন্য ভারতকে প্রয়োজন হবে। ‘পুরো উদ্যোগের মধ্যে ভারতকে একটা বার্তা দেওয়ার বিষয় থাকতে পারে। আবার চীন অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছে ভারতকে বন্ধু হিসেবে পেতে। কিন্তু তাতে ভারত উৎসাহিত নয়। কিন্তু এখন যদি একজনেরটা আরেকজন দিয়ে পোষানোর চিন্তা করা হয়, সেটিও খুব একটা কাজে দেবে না।’
ওবায়দুল হক অবশ্য বলছেন, তার ধারণা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকেই চীনের দিক থেকে ‘ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা’র উদ্যোগটি এসেছে। ‘চীনের দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য আনার চেষ্টার জন্য এটাই ভালো সময়। তবে এখনো কোনো জোট হয়নি। তিন দেশের মধ্যেই অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলোর সমাধান খুব একটা সহজ নয়।’