যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছিলেন। তাঁদের সেই ফোনালাপে ‘বাংলাদেশ’ প্রসঙ্গ এসেছে বলে নরেন্দ্র মোদির এক্স হ্যান্ডলার ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ওই ফোনালাপের বিষয়ে প্রচারিত হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ নেই।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সাধারণত শীর্ষ নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়, তার প্রতিফলন ঘটে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে। ফলে সরকারি ভাষ্যে যেটা প্রকাশ করা হয়, সেটাকেই আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে ধরে নিতে হয়। এর বাইরে যদি একজন কোনো বিষয় তুলে থাকেন আর অন্যজন একই বিষয়ে একমত না হন, সেটি সরকারি ভাষ্যে উল্লেখ থাকে না।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, মোদির সাম্প্রতিক পোল্যান্ড ও ইউক্রেন সফর নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন বাইডেন। পাশাপাশি আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক নিয়েও তিনি মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিবৃতির তথ্য অনুযায়ী, পোল্যান্ড ও ইউক্রেনে ঐতিহাসিক সফরের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন বাইডেন। কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী এমন সফর করেছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার বার্তা, জ্বালানি খাতসহ ইউক্রেনের জন্য চলমান মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির দেওয়া বার্তার প্রশংসা করেছেন জো বাইডেন। একই সঙ্গে জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য দুই নেতা তাঁদের অব্যাহত সমর্থনের বিষয়ে ফোনালাপে প্রতিশ্রুতি দেন।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি রক্ষায় ভূমিকা রাখতে কোয়াডের মতো আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করতে তাঁদের অব্যাহত প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের সম্মাননীয় অধ্যাপক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো আলী রীয়াজ গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, চিরাচরিতভাবে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে যেকোনো ফোনালাপ হলে তা সরকারি ভাষ্যে উল্লেখ থাকে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সোমবারের আলাপের বিষয়টি হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে রয়েছে। তবে ‘বাংলাদেশ’ প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদি যা বলেছেন এবং ভারতের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বিষয়টির উল্লেখ নেই।
ফোনালাপের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি তাঁর এক্স হ্যান্ডলারে লিখেছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়েও তাঁরা আলোচনা করেছেন। দেশটিতে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার ওপর তাঁরা জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দুই নেতা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অভিন্ন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং হিন্দু সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, বাংলাদেশের বিষয়টি যদি তাঁদের (বাইডেন-মোদি) আলোচনায় এসেও থাকে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ভারত যেভাবে উদ্বেগের দৃষ্টিতে দেখতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে ভারতের মতো সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে আনতে চায়নি।’
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতায় আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ভারত এ পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গতকাল রাতে মুঠোফোনে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুই শীর্ষ নেতার ফোনালাপের পর হোয়াইট হাউস থেকে যে বিবৃতি এসেছে, সেটাই তথ্যভিত্তিক মনে হয়েছে। তাঁরা দুজন যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, তাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিষয়টি আসা প্রাসঙ্গিক ছিল না। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আমরা আরও তথ্যভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত বক্তব্য শুনতে চাই।’