যাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি একাধিক বিকল্পের মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নামও বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে চার বছর আগে দলের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে কামারুজ্জামান এসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতে কামারুজ্জামান নিজেসহ জামায়াতের আটক নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কা এবং যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতের করুণ পরিণতি সম্পর্কে পূর্বাভাসও ছিল। তবে চিঠিতে পাকিস্তানের কারণে জামায়াতের গায়ে কাদা লেগেছে বললেও নিজেদের একাত্তর সালের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি।
এক. ‘যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব।’
দুই. ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।’
তিন. ‘আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তাঁরা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব। অর্থাৎ, একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবের পক্ষে একটি বিস্তারিত রূপরেখাও দিয়েছিলেন কামারুজ্জামান। তাতে ‘সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে ঢোকানো’ এবং কৌশলের অংশ হিসেবে যুব ও ছাত্রদের সহায়তায় ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দল, প্রয়োজনে ক্লাব গঠন করার কথাও বলেছিলেন।
কামারুজ্জামানের এই চিঠি নিয়ে দলে তখন কিছুটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। চিঠিতে লেখা সতর্কবাণী নিয়ে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী এবং দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একটি অংশ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে দলের নীতিনির্ধারকদের সম্পর্কে সে সময় নানা মন্তব্য করে।
জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, কামারুজ্জামানের ওই চিঠি নিয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। এ বিষয়ে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজাহারুল ইসলামের (পরে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী) সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। চিঠির বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘কারাগারে যাঁরা আছেন, তাঁরা দল পরিচালনার জন্য বাইরের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। কেউ যদি এমন কিছু করার চেষ্টা করেন, তা হবে দল ভাঙার ষড়যন্ত্র।’ তখন তিনি এ প্রশ্নও তুলেছিলেন, ‘এত বড় চিঠি কারাগার থেকে এল কী করে?’
নিজের তিন বিকল্পের ব্যাখ্যায় কামারুজ্জামান চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।’
এ বিষয়ে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ও জামায়াতের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি শামসুন্নাহার নিজামী ২০১১ সালের ১১ ও ২৫ মার্চ সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় দুই কিস্তিতে একটি নিবন্ধ লেখেন। ‘বিবেচনায় আনতে হবে সবকিছু’-এ শিরোনামে লেখা ওই নিবন্ধে তিনি কামারুজ্জামানের চিঠির কিছু জবাব দেন।
শামসুন্নাহার নিজামী লেখেন, জামায়াত মনে করে, যেকোনো পরিস্থিতিতে বা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো কর্মকৌশল নয়, বরং শাশ্বত কর্মকৌশলই অবলম্বন করতে হবে। পরিস্থিতি যতই নাজুক হোক, চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক; শর্টকাট কোনো পথ নেই।
কামারুজ্জামান কারাগারে আটক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না।’ তিনি আরও লেখেন, ‘দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি, সবাই মিলে তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাঙ্ক্ষিত এবং যুক্তিযুক্ত। এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী শিক্ষক ও সিনেট সদস্য তানভীর মুহাম্মদ হায়দার ‘আইএমবিডিডটব্লগডটকম’-এ কামারুজ্জামানের চিঠির সমর্থনে লেখেন, ‘কোনো লাভ নেই। যাঁরা তখন বুঝেননি, তাঁদের একে একে বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। আর যাঁরা বাকি থাকবেন, তাঁরা বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত বুঝবেন না। বাধ্য হয়ে বুঝার পর আবারও নিজ গুণগানে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন।’
চিঠিতে কামারুজ্জামান দেশের গণমাধ্যমকে দোষারোপ করে লেখেন, ‘মিডিয়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বানিয়ে ফেলেছে। যদি সরকারের বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী বিচারকার্য চলে, তাহলে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে দেশে-বিদেশে চিহ্নিত হয়ে যাবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
চিঠিতে কামারুজ্জামান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি খেদও প্রকাশ করে লেখেন, ‘জামায়াতের ওপর এবং জামায়াতের নেতা হিসেবে আমাদের ওপর সুস্পষ্ট জুলুম হচ্ছে। এ জন্য অনেকে দুঃখ প্রকাশ বা নিন্দা করলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কার্যকরভাবে আমাদের তথা জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিচারকাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মৌখিক সৌজন্য প্রকাশ করলেও একটি ইসলামি দলের নেতাদের শাস্তি হলে ভেতরে-ভেতরে তারা অখুশি হবে না।’
এখন দলটির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার বছর আগে কামারুজ্জামান যা লিখেছিলেন, এখন তার অনেকটাই ফলে গেছে। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব তা আমলে তো নেনইনি, কেউ কেউ এর বিরুদ্ধাচরণও করেছেন।
গত বছরের নভেম্বরে এই চিঠির বিষয়ে কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহারের সঙ্গে কথা হয় । তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা দেখেছি, দলের জন্য তিনি (কামারুজ্জামান) যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার অনেকগুলো বাস্তবে ফলে গেছে।’
কামারুজ্জামান চিঠিতে বলেছিলেন, ‘জামায়াতের অনেকে মনে করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার বিষয়টি একসময় মিটমাট হয়ে যাবে।…যেহেতু বিষয়টি আমরা মিটমাট করতে পারিনি অথবা এই রাজনৈতিক বিরোধটি মীমাংসা করতে পারিনি, যেহেতু আমরা অনেকেই মনে করেছিলাম এটা একসময়ে এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে, যেহেতু আমাদের অনেকের চিন্তার গণ্ডি অতিক্রম করে এটা একটা জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেহেতু সরকারও এ বিষয়ে অবশ্যই একটা কিছু করতে বদ্ধপরিকর এবং যেহেতু কিছু না হলেও দল ও নেতৃত্বের ভাবমর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে এবং জনমনে একধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু সামগ্রিক বিবেচনায় নতুন কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি।’
নতুনভাবে সংগঠনের রূপরেখা
পরিস্থিতি বিবেচনায় জামায়াতকে পেছন থেকে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে নতুন প্ল্যাটফর্মে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কৌশল গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন কামারুজ্জামান। তাঁর মতে, সেই প্ল্যাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে কেউ সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই।
কামারুজ্জামান প্রস্তাব করেছিলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। ছায়া মন্ত্রিসভার ধারণা গ্রহণ করতে হবে। তিনবারের বেশি কেউ কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। যুব ও ছাত্রদের সহায়তায় ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দল, প্রয়োজনে ক্লাব গঠন করতে হবে। সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে ঢোকাতে হবে।
কামারুজ্জামানের এই প্রস্তাবের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে বললে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, টিকে থাকার জন্য জামায়াত নাম পাল্টানোসহ সব ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। তবে তাদের মওদুদিবাদ থেকে যাবে। হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের বৈধতা দেওয়ার রাজনীতি বা আদর্শ থেকে যাবে। – প্রথম আলো