স্বাগত জানাল বিশ্ব ইরানে জয়োল্লাস

SHARE

irann4ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইরান চুক্তিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দাবি করেছে। গতকাল শুক্রবার তেহরানে জয়োল্লাস করে ইরানিরা। দেড় বছরের দরকষাকষি ও আলোচনার পর ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে ব্যাপক ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। বিনিময়ে দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে। সুইজারল্যান্ডের লুসানে টানা আট দিনের ম্যারাথন আলোচনার পর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে এমন শর্ত রেখে প্রাথমিক একটি সমঝোতা চুক্তিতে পেঁৗছান ইরান ও ছয়বিশ্বশক্তির আলোচকরা। খবর এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি অনলাইনের।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্ব নেতারা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা বৃহস্পতিবারই ইরানের দুই প্রতিপক্ষ দেশ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সৌদি আরবের বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। নেতানিয়াহু এ চুক্তিকে ইসরায়েলের ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে সৌদি বাদশা সালমান এ চুক্তির ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা সুসংহত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি চূড়ান্ত চুক্তি করতে আরও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। চুক্তির বিরোধিতাকারীরা শক্তিধর হওয়াতে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধানে পেঁৗছানো যাবে কি-না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে তাদের।

আমরা সঠিক পথেই আছিপ্রাথমিক চুক্তির পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কারভাবে, প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবেও বলেছি চূড়ান্ত সমঝোতা প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করবে না। এটি নির্ভর করবে (শর্ত পালনের) প্রমাণের ওপর।’ জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ সমঝোতার কারণে ইরানের জন্য পরমাণু অস্ত্র তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়বে।

প্যারিসে ফিরে গতকাল ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরাঁ ফ্যাবিয়াস বলেন, তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সময় নির্ধারণ বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ইরান চায় শিগগিরই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা এখনও হয়নি। আমরা তাদের বলেছি, আপনারা যে বিষয়ে সম্মত হয়েছেন তা কতটা পালন করছেন তার ওপর ভিত্তি করে আমরা অবরোধ শিথিল করব। যদি পালন না করতে পারেন তবে আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যাব।’ ফ্যাবিয়াস বলেন, ‘আমরা সঠিক পথেই আছি। তবে আমরা এখনও পথের শেষ প্রান্তে পেঁৗছাইনি।’ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেন, ‘১৮ মাস আগে আমাদের অনেকে যা সম্ভব বলে ভাবতে পারেননি তার চেয়ে এটি অনেক ভালো হয়েছে। তবে এখনও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।’

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি গতকাল শুক্রবার বলেন, এ চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হবে। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, অন্যরা যদি তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলে আমরাও আমাদের প্রতিশ্রুতি মানব। তিনি বলেন, বিশ্ববাসী জানে আমাদের প্রতারণা করার কোনো অভিপ্রায় নেই। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, এ চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। এবং ওই অঞ্চলে যেসব গুরুতর বিষয় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সেসব সমাধানের সুযোগ করে দেবে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ঐতিহাসিক রূপরেখা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। দিলি্লতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভারত সব সময় বলে এসেছে, পারমাণবিক জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করার যে অধিকার ইরানের রয়েছে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আসছে। এতে আরও বলা হয়েছে, কূটনৈতিক সাফল্য ও সর্বাত্মক আলোচনার মাধ্যমে বৃহস্পতিবার রূপরেখা চুক্তির প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। সিরিয়া সরকারও চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ চুক্তির ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।

তেহরানের রাস্তায় রাস্তায় আনন্দ মিছিল বৃহস্পতিবার সমঝোতার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তেহরানে উল্লাস শুরু হয়। বিধ্বস্ত অর্থনীতির জাঁতাকলে থাকা ইরানিরা রাস্তায় নেমে আনন্দ মিছিল করে নেচে-গেয়ে এবং গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। রূপরেখা ঘোষণার সফলতা নিয়ে ইরানের আলোচকরা দেশে ফেরার পরই তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় ইরানিরা। চুক্তির ফলে ইরানের বিজয় হয়েছে বলে মনে করছেন তাদের অনেকে। ইরানিরা বলছেন, এখন তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ‘স্বাভাবিকভাবে’ জীবনযাপন করতে পারবেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটার আশাই তাদের এ উচ্ছ্বাসের মূল কারণ।ইরানকে পরমাণু সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা রাশিয়ার :প্রাথমিক সমঝোতা হওয়ার পরপরই রাশিয়ার উপপরাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেছেন, মস্কোর পরমাণু শক্তি সংস্থা রোসাটম ইরানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চুলি্লগুলোতে নতুন জ্বালানি সরবরাহ করতে এবং ব্যবহৃত জ্বালানি রড প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে। এর আগে চুক্তির বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সংকটাপন্ন পরিস্থিতিও যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সমাধান করা সম্ভব এটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ‘নিরাপদ মাত্রায়’ সীমিত করতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছিল পশ্চিমারা। এ লক্ষ্যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে ছয় মাসের একটি অন্তর্বর্তী চুক্তিও করেছিল ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি)। পরে দু’দফা মেয়াদ বাড়িয়ে একটি রাজনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নের জন্য ৩১ মার্চ চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত সময়েও আলোচনা শেষ না হওয়ায় দু’দিন সময় বাড়িয়ে অবশেষে বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক সমঝোতায় পেঁৗছান আলোচকরা। চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ না করে ৩০ জুনের মধ্যেই চূড়ান্ত চুক্তি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা। পূর্ণাঙ্গ চুক্তি হলেই কেবল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইস্যুতে এক যুগের বেশি সময় ধরে চলা টানাপড়েনের অবসান হবে। তবে প্রাথমিক সমঝোতা হলেও তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত চুক্তি হবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, ইরান তার পরমাণু সমৃদ্ধকরণের সক্ষমতা দুই-তৃতীয়াংশ এবং সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ ৯৮ শতাংশ হ্রাস করতে সম্মত হয়েছে। এই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামই পরমাণু বোমার মূল উপকরণ। এছাড়া ইরান তার আরাক ভারী পানির চুলি্লতেও গঠনগত পরিবর্তন আনতে রাজি হয়েছে। যেন আর প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করা না যায়। পরমাণু বোমা তৈরিতে ইউরেনিয়ামের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্লুটোনিয়াম। তেহরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) কঠোর নজরদারির আওতায় থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এসব শর্ত মানা হলে পরমাণু উপকরণ দিয়ে কোনো বোমা তৈরির ‘ব্রেকআউট টাইম’ প্রলম্বিত হবে কমপক্ষে এক বছর। সে ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি সহজেই শনাক্ত করা যাবে। পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ারও যথেষ্ট সময় পাবে আন্তর্জাতিক মহল।

প্রাথমিক চুক্তি হলেও ইরানের ওপর থেকে এখনই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হচ্ছে না। ৩০ জুন চূড়ান্ত চুক্তি হলেই কেবল নিষেধাজ্ঞাগুলো পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা শুরু হবে। যদি চুক্তি অনুসরণ না করে তাহলে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। আলোচনার পুরোটা সময়ে ইরানের দাবি ছিল চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার। তবে শেষ মুহূর্তে এসে নাটকীয়ভাবে পিছু হটে তেহরান। পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহারের শর্তেই রাজি হয়ে যান দেশটির আলোচকরা। এখন আগামী তিন মাস ধরেই ইরানের ওপর আরোপিত কোন নিষেধাজ্ঞা কখন প্রত্যাহার করা হবে তা নির্ধারণ করা হবে।