আগামীকাল বৃহস্পতিবার মেলবোর্নে ভারতের বিপক্ষে যে সব কারণে জিতবে বাংলাদেশ। যে সবের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের অলরাউন্ড নৈপুণ্য। যা ভারত থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ। এছাড়া আমরা জিতব বোলিংয়ে শক্তিতে, জিতব দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে, জিতব সাফল্যের ব্যাটিংয়ে।
অধিনায়ক মাশরাফিও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে নির্ধারক হবে- আমাদের বোলিং। তার দাবির পক্ষেই নিজের ভোট দিয়ে কিউই অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বলেছেন, বাংলাদেশের পেসাররা গত কয়েক বছরের তুলনায় এখন বেশি হুমকির কারণ। আর সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের তিন প্রকৃত অলরাউন্ডারের সঙ্গে তো ভারতের তুলনাই চলে না। ভুলে যাবেন না বাংলাদেশ স্কোয়াডে থাকছে বৈচিত্র্যময় আট বোলার। অবশ্য টাইগারদের শক্তির আসল রহস্য ফাঁস করে ভারতের ওপর চাপের মাত্রাটা বাড়িয়েই দিয়েছেন বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে- ‘ব্যর্থ হতে হবে, এই ভয়টাই নেই বাংলাদেশ দলে।’ সত্যিই একতরফা নয়, যুক্তির কথাই বলছি। ধৈর্য না হারিয়ে সঙ্গেই থাকুন। দেখুন আমাদের শক্তিমত্তা, বিজয়ের পক্ষে নানা যুক্তিতর্ক এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ।
উজ্জীবিত বাংলাদেশ বনাম চাপে ন্যুব্জ ভারত
এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে উজ্জীবিত দলের নাম বাংলাদেশ। দুটি কারণে এ পার্থক্য। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সে পার্থক্য কোথায়। তবুও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। মাশরাফির নাম শুনলে নাকি ভারতীয়দের কলজে কেঁপে ওঠে। জেগে ওঠে পুরনো ক্ষতের ব্যথা। এবার মাশরাফির সুইংয়ের সঙ্গে কিন্তু যুক্ত হচ্ছে তাসকিনের গতি ও রুবেলের ইয়র্কার। পা তো কাঁপবেই। আর বাংলাদেশের তামিম ইকবাল। ডাউন দ্য উইকেটে এসে এমন মার দিয়েছিল- ভারতের ক্রিকেটাররা তো একবার তার চাহনির মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিল আক্রমণাত্মক মনোভাব। তার চাহনির বিপরীতে বল করতে নাকি বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল তাদের। সে তামিম এবার ব্যর্থতার কারণে নিন্দার কাঁটায় বিদ্ধ। হয়তো ভারতের বিরুদ্ধেই ঝাল ঝাড়ার অপেক্ষা তার। সেরাটা জমিয়ে রেখেছেন ভারতের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ ঘটাবেন বলে। যাহোক, ভারতের ব্যাটিং বিশ্বজোড়া সুনামের অধিকারী। এ সত্যের সঙ্গে আরেক সত্য হচ্ছে- কোহলি-ধোনি ছাড়া সব তারকাই বড্ড ম্রিয়মান বাংলাদেশের সামনে। রেকর্ড কিন্তু তাই বলে। বর্তমান টপঅর্ডারের মধ্যে কোহলিই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৬ ম্যাচ খেলে সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিনটি। ১০ ম্যাচ খেলে ধোনি মাত্র ১ সেঞ্চুরিসহ ৩৩৮ রান। রোহিত বেচারা ৫ ম্যাচে করেছেন ৭৩। রাহানে চার ম্যাচে ১৩৭ এবং ধাওয়ান এক ম্যাচে ২৮। এবার আসুন বাংলাদেশের শক্তির অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে। প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচে হেরেও জিতেছে বাংলাদেশ। গ্রুপের শীর্ষ দল নিউজিল্যান্ডের কাছে শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া যেখানে হেরেছে আর নাকানি-চুবানি খেয়েছে সকলে; সেখানে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। অধিনায়ককে ছাড়াও দুর্দান্ত এ লড়াই বাংলাদেশকে নিয়ে এসেছে প্রচারের আলোকবিন্দুতে। অন্যদিকে শেষ ম্যাচে জিতলেও টেস্ট ক্রিকেটের দুর্বলতম দল জিম্বাবুয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছে ভারতকে। এ জয় তাদের পরাজয়ের অধিক। মনে রাখুন, বাংলাদেশ কিন্তু সেই দেশ; যারা বিশ্বকাপের মঞ্চে পরাশক্তিকে ধরিয়ে দিতে ওস্তাদ। সে কথা ভুলতে পারবে কি পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ? ভারত তো কোনভাবেই ভুলতে পারবে না। মনে নেই ২০০৭ বিশ্বকাপের কথা? বাংলাদেশের কাছে হেরেই বাক্স-পেটরা বেঁধে ভারতমুখী বিমানে চাপতে হয়েছে তাদের। সে দুঃসহ স্মৃতি কি কুরে কুরে খাবে না ভারতীয় ক্রিকেট দলকে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্রথম পর্বের দুইটি ম্যাচ বাকি থাকতেই কোয়ার্টারের মঞ্চে চোখ রেখেছিল বাংলাদেশ। আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা। মানসিকভাবে প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে ভেতরে ভেতরে। ভারত ভেবেছিল অপফর্মে খোঁড়ানো ইংল্যান্ডকে পাবে কোয়ার্টারে। খোঁড়া ঘোড়াকে চাবকে বনবে বাহাদুর। তাদের সে প্রত্যাশার কথা কিন্তু শেষমেশ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। ভারতের এক ক্রিকেট কিংবদন্তি তো বলেই ফেলেছেন, ইংল্যান্ড হলে ভালো হতো! আর বাংলাদেশ খেলবে নির্ভার। শুনবেন, মাশরাফি কি বলেছেন? উহ! ‘এই মুহূর্তে চাপটাপ নিয়ে একদমই ভাবি না।’
দেশপ্রেম, ঐক্য এবং সমর্থন
বাংলাদেশ যখন মাঠে খেলে তখন ১১জন নয়, খেলে কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বত্রই তখন একই সুর, একই আওয়াজ। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। বাংলাদেশী ক্রিকেটাররাও জীবনবাজি রেখে খেলার মাধ্যমে সে আবেগের প্রতি সম্মান দেখান। না, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফির কথা কে না জানে? দু’তিনবার চিকিৎসকের ছুরির নিচে গেলেই যেখানে পেস বোলাররা রাস্তা মাপেন সেখানে সাতবার চিকিৎসকের টেবিল শুয়ে, পঙ্গুত্ব বরণের ঝুঁকি নিয়েও দেশের জন্য খেলছেন মাশরাফি। এই বাংলাদেশ ম্যাচের আগে ছুটে যায় বিদেশ বিভুঁইয়ের শহীদ মিনারে। জয় উৎসর্গ করতে জানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের। বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই ক্রিকেটীয় কৌশলের সঙ্গে দেশপ্রেমের রসায়ন। আর ভারতের দিকে দৃষ্টি দিন। দেখবেন, দেশপ্রেম নয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জনের পথ তৈরি ও রক্ষাই তাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে ঐক্যে কোন ঘাটতি নেই। একজন মাশরাফির প্রতি রয়েছে সবার প্রশ্নাতীত আনুগত্য। কিন্তু সেটা পাবেন না ভারতে। যতই তারা চাপা দিয়ে রাখুক না কেন। শ্রেষ্ঠত্বের হামবড়া ভাব, প্রদেশের আধিপত্য মিলিয়ে রয়েছে কোন্দলের ধারাবাহিকতা। এইতো সেদিন বিশ্বকাপের প্রাক্কালে, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই শেখর ধাওয়ানের দিকে ছুরি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন নাকি অধিনায়ক কোহলি। ভাগ্যিস, দুর্ঘটনা ঘটেনি। সবাই জানে, বাংলাদেশের প্রত্যেক ক্রিকেটারের মাতৃভাষা বাংলা। সবাই একই বোলে অভ্যস্ত। একই সংস্কৃতির ধারক-বাহক। কিন্তু ভারতের ক্রিকেটারদের মাতৃভাষা একাধিক। তাদের ব্যবহার করতে হয় পরের ভাষা। ভারতীয় শিবিরে ভাগ হয়ে থাকে জাট, মাউরা, মারাটি, তামিল নানা সংস্কৃতি। বলুন না, আন্তরিকতার বন্ধনে কারা সুদৃঢ়?
পেস বোলিং: ধরে দিবানে
পেস বোলিংয়ে এই মুহূর্তে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভাল। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্য, গতি ও সুইংয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশের পেস অ্যাটাক ভেঙে দিতে পারে যে কোন ব্যাটিং লাইনআপ। বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও নবীন পেসার দুজনই বাংলাদেশের। ভারতীয় দলের তিন পেসারের যৌথ অভিজ্ঞতা (১০৬) ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফির অভিজ্ঞতা ঢের বেশি (১৪৮)। বাংলাদেশের তিন মূল পেসার (মাশরাফি, রুবেল ও তাসকিন)-এর রয়েছে যৌথভাবে ২১৪ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা। শিকার সংখ্যা ২৭৮। ভারতের মূল তিন পেসার (সামি, যাদব ও মোহিত)’র রয়েছে ১০৬ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা। শিকার সংখ্যা ১৬৪। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটি ম্যাচ খেলতে পারেনি। আবার মাশরাফি বিশ্রামে ছিলেন এক ম্যাচ। প্রথম পর্বে তিনজনের (যৌথভাবে) ১৪ ম্যাচে উইকেট সংখ্যা ১৯টি। অন্যদিকে ভারতের তিনজনের (যৌথভাবে) ১৭ ম্যাচে উইকেট সংখ্যা ৩৫টি। কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে আছে অন্য একটি জায়গায়, আর তা হলো বোলিং ফিগারে। বাংলাদেশের তিন পেসারের সেরা বোলিং ৬/২৬, ৬/২৬, ৫/২৫ এর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে ভারতের পেসাররা ৪/৩৫, ৪/৫৩, ৪/২২।
অলরাউন্ডার: পারফরমেন্সে এগিয়ে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ-ভারত দুই দলের খেলোয়াড়দের অলরাউন্ড পারফরমেন্সে এগিয়ে বাংলাদেশই। রেকর্ড এবং বিশ্লেষণ তাই প্রমাণ দেয়। বাংলাদেশের প্রধান তিন অলরাউন্ডার সাকিব, রিয়াদ ও সাব্বির। তিনজনই প্রকৃত অলরাউন্ডার। অন্যদিকে ভারতের প্রধান তিন অলরাউন্ডার অশ্বিন, জাদেজা ও রায়না। তারা ব্যাটিং নির্ভর অনেকটাই। অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। আসুন বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। বাংলাদেশের তিনজনের ব্যাটিং গড় ৩৫.২৪, ৩৪.৯৮, ৩৩.৫৭। বিপরীতে ভারতের তিনজনের গড় ৩৬.১৬, ৩২.৩৩, ১৭.৯১। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তিনজনের ১৩৪*, ১২৮*, ৫৩’র বিপরীতে ভারতের তিনজনের ১১৬, ৮৭, ৬৫। বাংলাদেশের তিন অলরাউন্ডারের ৮ সেঞ্চুরি ও ৪১ হাফ সেঞ্চুরির বিপরীতে ভারতের তিনজনের ৫ সেঞ্চুরি ও ৪৬ হাফ সেঞ্চুরি। ব্যাটিংয়ে তাহলে কে এগিয়ে থাকল? নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ। আসুন এবার বোলিং বিশ্লেষণে। বাংলাদেশের তিন মূল অলরাউন্ডারের সেরা ফিগার ৪/১৬, ৩/৪, ১/৩-এর বিপরীতে ভারতের তিন অলরাউন্ডারের ৪/২৫, ৫/৩৬, ৩/৩৪। বোলিং ইকোনমিতে বাংলাদেশের গড় ১৪.৮২ ভারতের ১৪.৭৬। কি বলবেন? নিশ্চয়ই একতরফা নয়। তবে হ্যাঁ, একটি জায়গায় তারা এগিয়ে। ভারতের তিন অলরাউন্ডারের যৌথভাবে ৩৮৮ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতার বিপরীতে বাংলাদেশের তিনজনের অভিজ্ঞতা ২৫৬। ভারতের তিন অলরাউন্ডার ১৩২ ম্যাচ বেশি খেলে কত রান ও উইকেট বেশি পেয়েছে জানেন? মাত্র ৮০০ রান ও ৪৭টি। ভারতের অলরাউন্ডারদের ৭৬৬৫ ও ৩০৫ এর বিপরীতে বাংলাদেশের ৬৮৬৫ ও ২৫৮ উইকেট। বুঝতেই পারছেন সাকিব-রিয়াদরাই সেরা। এসব বিশ্লেষণ পড়ে আপনি নিশ্চয়ই কপাল কুচকে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্বকাপে কারা কি করল? দেখুন তাহলে। প্রথম পর্বে বাংলাদেশের চেয়ে একটি ম্যাচ বেশি খেলেছে ভারত। কিন্তু তিন অলরাউন্ডারের সংগ্রহ দেখুন। বাংলাদেশের তিনজনের সংগ্রহ ৬৬২ রান ও ৯ উইকেটের বিপরীতে ভারতের তিনজনের ২৫৮ রান ও ২০ উইকেট। দেখতেই পাচ্ছেন একটি ম্যাচ কম খেলেও ব্যাটিংয়ে সাকিব-রিয়াদ-সাব্বির তাদের আড়াইগুণ রান করেছেন। এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের তিন অলরাউন্ডার ধারাবাহিকতা দেখালেও ভারতের জাদেজা তিন ম্যাচে আউট হয়েছেন মাত্র ১৮ রানে। আর বাংলাদেশের বিশ্বকাপ তারকা রিয়াদ করেছেন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। এখানেও শেষ নয়, বাংলাদেশের অলরাউন্ডারদের শক্তির জায়গা কিন্তু অন্য কোনখানে। কোথায় সেটা? হ্যাঁ, একটি জায়গা আছে যেটা আপনি বিবেচনা না করে পারবেনই না। সেটা হচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের অলরাউন্ডাররা চাপ নিয়ে বিপর্যয় সামাল দিতে ও লড়াই করতে অভ্যস্ত। এই জায়গায় তো দারুণভাবে পিছিয়ে থাকবে ভারত। আর ভুলে যাবেন না কিন্তু বাংলাদেশকে অলরাউন্ড ভূমিকায় নেতৃত্ব দেবেন বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসান।
স্পিন বোলিং: সাকিবের ঘূর্ণিবলে নড়বড়ে কোহলি
বাংলাদেশের স্পিন বোলিংয়ের সুনাম বিশ্বজোড়া। স্পিন বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেবেন ঘূর্ণি সাকিব। যার বোলিং মোকাবিলা করতে গিয়ে বারবার নাকানি-চুবানি খেয়েছেন রোহিত, কোহলি ও ধোনি। প্রথম পর্বের ম্যাচগুলোতে ভারত খেলিয়েছে মাত্র দুইজন স্পিনারকে। বিপরীতে বাংলাদেশের এ সংখ্যা ৫-এর অধিক। বাংলাদেশ স্কোয়াডে অন্তত ৮জন বোলারের উপস্থিতি সর্বদা। বাংলাদেশের বোলিং বৈচিত্র্য ও চেঞ্জের সুযোগ তাই ভারতের চেয়ে অনেক বেশি।
ব্যাটিং: ভারতের দৃঢ়তার বিপরীতে বাংলাদেশের সাফল্যের রেকর্ড
ক্রিকেটে ভারতের চিরাচরিত শক্তির জায়গা ব্যাটিং। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ দেশটির। টপঅর্ডারে দলটির এমন ৫ জন ব্যাটসম্যান রয়েছে যাদের একজন দাঁড়িয়ে গেলেই যে কোন বোলিং লাইনআপকে করে দিতে পারে ভোঁতা। রোহিত, ধাওয়ান, কোহলি, রাহানে ও ধোনি- পঞ্চপা-বের রেকর্ডের দিকে চোখ রাখলে যে কোন দলই ভয়ে নেতিয়ে যাবে। ব্যাটিংয়ের ৫ জনের রয়েছে ৫১০ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা। তাদের সংগৃহীত রানের সংখ্যা ২৪৯৬১। রোহিতের ডবল সেঞ্চুরি ও কোহলি এবং ধোনির প্রায় ডবল সেঞ্চুরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোহলি ও ধোনির ব্যাটিং গড় ৫২-এর উপরে। বাকি তিনজনেরও ৩১-৪৪’র মধ্যে। ৫ জনের মোট সেঞ্চুরি সংখ্যা ৪৭ এবং হাফ সেঞ্চুরির ১৩৬টি। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের ৬ ম্যাচ খেলেও শীর্ষ ৫ রান সংগ্রাহকের তালিকা জায়গা পাননি তাদের কেউ। সুযোগ মেলেনি স্বপ্নের টিমেও। যদিও প্রথম পর্বে তারা সংগ্রহ করেছেন ১১০৮ রান এবং দুইজনের সংগ্রহ ৩০০ এর উপরে। ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ বিশ্লেষণের পর বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের দিকে তাকালে আপনার হাতি দেখার পর হরিণ দেখার মতো মনে হতে পারে। এ কথা স্বীকার করতে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ অনিশ্চয়তাপূর্ণ, ভঙ্গুর। ভারতের যেখানে ৫ জন নিয়মিত টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান রয়েছে সেখানে প্রথম পর্বে বাংলাদেশের পক্ষে নিয়মিত খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র তিনজন তামিম, সৌম্য ও মুশফিক। ইনজুরির কারণে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান পাল্টানো হয়েছে তিনবার। ফর্মে নেই সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। যাহোক, তিন নিয়মিত টপঅর্ডারের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ৪৩৯টি এবং সংগৃহীত রান ৭৬৯০। সেঞ্চুরির অভিজ্ঞতা রয়েছে মাত্র তামিম ও মুশফিক দুজনের। সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরির সংখ্যা ভারতের ব্যাটসম্যানদের তুলনায় রীতিমতো নগন্য (৮ ও ৩৯)। এসব রেকর্ড দেখতে দেখতে আপনি হয়তো চোখ কপালে তুলেছেন। কিন্তু না, ভয় পাবার কিছু নেই। তাদের চেয়ে একটি ম্যাচ কম খেলে ভারতের ৫ টপঅর্ডারের বিপরীতে বাংলাদেশের তিন টপঅর্ডারের সংগ্রহ ৫৩৬। হিসাব করে দেখুন। ভারতের ৩৬.৯৩ গড়ের বিপরীতের বাংলাদেশের ৩৫.৭৩। বিশ্বাস হতে চাইছে না কিন্তু এটাই সত্যি। তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে মাত্র ১। ভারতের বিপক্ষে ভাল করার জন্যই যেন মুখিয়ে থাকেন বাংলাদেশের তারকারা। বাংলাদেশের প্রধান চার ব্যাটসম্যান তামিম, মুশফিক, সাকিব ও রিয়াদ। বোলার মাশরাফি এবং সাকিব তো ভারতবধের যম প্রায়। প্রত্যেকের ভারতের বিরুদ্ধে পারফরমেন্স ভাল। তামিম ১২ ম্যাচ খেলে ৫ হাফ সেঞ্চুরিসহ সংগ্রহ ৩৩ গড়ে ৪০১ রান। মুশফিক ১৩ ম্যাচ খেলে ১ সেঞ্চুরি ও ২ হাফ সেঞ্চুরিসহ ৪২ গড়ে ৪২১। সাকিব ১০ ম্যাচে ৫ হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৬ গড়ে ৩৬০ এবং রিয়াদ ৯ ম্যাচে ২ হাফ সেঞ্চুরিসহ ৪৯ গড়ে ২৪৮ রান। তামিমের কথাতো শচীন টেন্ডুলকার তার আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘…বাংলাদেশকে ঝড়ো সূচনা এনে দিলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। এতে তারা ৫ উইকেট হাতে রেখে খুব সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেল।’ শচীন উল্লেখ না করলেও ক্রিকেটপ্রেমীরা ভুলেনি মাশরাফি ৪ উইকেট নিয়ে ভারততে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ১৯১ রানে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ধোনি ও কোহলি যেমন একাধিক ম্যাচে অপরাজিত ছিল তেমনি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুশফিক ও রিয়াদ অপরাজিত ছিলেন একাধিক ম্যাচে।
স্কোয়াড: নিরাপদ অবস্থানের বিপরীতে চ্যালেঞ্জিং চেঞ্জ
বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে নিজেদের একটি নিরাপদ অবস্থানে রেখেই খেলেছে ভারত। ৬টি ম্যাচে তারা খেলিয়েছে মাত্র ১২জনকে। কেবল একটি ম্যাচে শামির বদলে মাঠে নেমেছিলেন বিনয়। এতে পরিস্কার যে, ভারত চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের ৫টি ম্যাচে বাংলাদেশ বারবার চ্যালেঞ্জিং চেঞ্জ দেখিয়েছে। ৫ ম্যাচে খেলিয়েছে ১৫জনকে। ৮জন মাত্র প্রতিটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্রামে ছিলেন খোদ অধিনায়ক মাশরাফি। একজন ইনফর্ম বোলার ও একজন মারকুটে ওপেনারকে হারালেও ফলাফলে তার প্রভাব পড়তে দেয়নি অন্যরা। কোয়ার্টারের মঞ্চ নিয়ে তাই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক মনোবিদ প্রফেসর ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব মনে করেন, ‘ইন্ডিয়া যদি কোন কারণে হারে… তবে, দেশের মাটিতে ওদের জায়গা হবে না। ঐখান থেকে… জাহান্নামে যাইতে হবে। বাংলাদেশকে দুইটা উইকেট টার্গেট করতে হবে, উপরে বিরাট কোহলি; নিচে ধোনি।’
হারানো কিছু নেই, পাবার আছে বহু কিছুই
ক্রিকেটপ্রেমীরা জানে- বড় আসরে মাঠের খেলা, টেবিলের খেলা, মাথার খেলা, খেলার পেছনের খেলা ও খেলার সামনের খেলায় অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত ক্রিকেট বিশ্বের তিন মোড়লের এক। সর্বশেষ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। এখানে বাংলাদেশের জয়ের আছে বহুকিছু। কিন্তু হারানোর কিছু নেই। অন্যদিকে ভারতের হারানোর আছে বহুকিছু। সম্মান তো যাবেই, ছড়ি ঘোরানোর জায়গা কমবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়ে যাবে বাণিজ্যে। ভারতের ক্রিকেট মানেই কিন্তু বাণিজ্যের তরী। ফলে বাংলাদেশ নয় চাপে থাকবে ভারতই। বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফির অঙ্গীকারের কথা জানেন? তিনি বলেছেন, একটা প্রমিজ করতে পারি- আমরা আমাদের রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব। এত দূর যখন এসেছি, সহজে ছাড়ব না। আমাদের মহাতারকা সাবিক তো ভয়-ডর উড়িয়ে দিয়েছেন, ‘ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই; বরং ভয়-ডরহীন ক্রিকেট খেলবে বাংলাদেশ।’ এখন বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরতে আপনার প্রয়োজন খানিকটা আবেগ এবং অফুরন্ত সাহস। আর আপনাকে সাহস জোগাবে খোদ ভারতের কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, কিরণ মোরে, ভিভিএস লক্ষ্মণ, দুরন্ত নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, কিউই কিংবদন্তি রিচার্ড হ্যাডলি। সুনীল গাভাস্কার বলেছেন, আমার মনে হয়- ভাগ্য সঙ্গে থাকলে ফর্মের তুঙ্গে থাকা বাংলাদেশ যেকোন দলকেই হারিয়ে দিতে পারে। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন বলেছেন, বিশ্বকাপে ভারতের কাঁটা হওয়ার ইতিহাসও আছে বাংলাদেশের। কিরণ মোরে বলেছেন, যে দলটা শেষ আটে উঠে এসেছে, বুঝতে হবে তাদের সামর্থ্য আছে বলেই তারা এ পর্যন্ত এসেছে। আর রিচার্ড হ্যাডলির চ্যালেঞ্জ, ‘গ্রুপ পর্বে অসাধারণ পারফরম্যান্সই বলে দেয়, ভারতের কঠিন পরীক্ষাই নেবে বাংলাদেশ।’ বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক অ্যান্ডি জ্যালজম্যান লিখেছেন, বাংলাদেশের সামনে এখন কোয়ার্টার ফাইনাল চ্যালেঞ্জ। এটি টাইটানিক জাহাজের মতো, যেখানে বরফখণ্ডের মতো বাধা বিখ্যাত ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ। ভারতীয় বোলিং হলো পেছনের একটু চেনা ছোট বরফখ-। খেয়াল করুন, তিনি বাংলাদেশকে তুলনা করেছেন টাইটানিকের সঙ্গে আর ভারত বরফখ-। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা তো জানেন। মিথের বরফখ- ভেঙেচুরে জয়ের বন্দরে পৌঁছবে ক্রিকেটের নতুন টাইটানিক বাংলাদেশ। হ্যাঁ, জিততেই যাচ্ছে বাংলাদেশ। উপভোগের জন্য প্রস্তুতি নিন- মাশরাফির বুক চিতিয়ে দেয়া ভঙ্গি, রুবেলের ঈগল উড়াল, রিয়াদের উড়ন্ত চুমু, তামিমের বোর্ডে নাম লেখানোর ইশারা, মুশফিকের শূন্যে লাফ, সাকিবের হৃদয়চিহ্ন দেখানো আর তাসকিনের বাঁধনহারা উদযাপন।