দণ্ডপ্রাপ্ত তারেককে ফিরিয়ে আনা এখনও ‘প্রক্রিয়াধীন’

SHARE

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম প্রধান দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে। সরকারের উচ্চ মহল থেকে জানানো হয়েছে, তারেক রহমানসহ সব পলাতক আসামিকেই দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা।

হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী। এ হামলা পরিকল্পনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমানকেই দায়ী করা হয়।

তারেক রহমান বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। বর্তমানে তার সাজা স্থগিত হওয়ায় তিনি গুলশানে নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। তবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে যুক্তরাজ্য থেকেই বিএনপির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন তারেক রহমান।

তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে তিনি দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করায় এ প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা সব পলাতক আসামিকে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি এবং সে কাজ চলছে। এটুকুই এখন বলতে পারব।’

অবশ্য এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি তিনি।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।

তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তখন জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলার ছক করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিল হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ৩০ জনকে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। তবে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত বিচার চলে ৪৯ জনের বিরুদ্ধে।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায় দেয়া হয়। এতে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়। এর মধ্যে তারেক রহমান যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন।

মামলার ৪৯ আসামির মধ্যে আটজন রাজনৈতিক নেতা, পাঁচজন সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য এবং আটজন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। বাকি ৩১ জন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গি।

পলাতক আসামিরা কে কোথায়

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ পলাতক আসামির সংখ্যা ১৫ জন। এদের মধ্যে তারেকসহ তিনজনের অবস্থান বিষয়ে তথ্য আছে সরকারের কাছে। বাকিরা কোথায় সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ফরিদপুরের দুই ভাই মুরছালিন ও মুত্তাকিনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য আছে। বাকিদের মধ্যে ৫ থেকে ৬ জনের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা যায়, অন্যদের বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই।

দণ্ডিত ৪৯ আসামির মধ্যে ৩৪ জন কারাগারে, ৯ জন জামিনে আছেন। বাকি ১৫ জন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

২০১৮ সালে যখন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়, তখন মোট পলাতক আসামির সংখ্যা ছিল ১৮ জন। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইকবাল হোসেনকে দিয়াবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সাবেক পুলিশের ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আত্মসমর্পণ করেন।

দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ কাজী মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারি হয়েছিল ইন্টারপোল থেকে। কিন্তু তারেক ও কায়কোবাদের রিভিউ আবেদনের পর এ দুটি নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।

তারেক রহমানের অবস্থান যুক্তরাজ্যে। বাকিরা কে, কোথায় আছেন, তা নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছে ইন্টারপোলের বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।

তারা বলছে, কায়কোবাদ যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রেড নোটিশ থাকা মাওলানা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন মিয়া পাকিস্তানে, রাতুল আহমেদ বাবু ইতালি বা দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং মোহাম্মদ হানিফ থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায়। তবে নিশ্চিত তথ্য নেই।

এদের মধ্যে তাজউদ্দিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। তার আরও দুই ভাই শামছুল আলম টাঙ্গাইল বিএনপির নেতা আর সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক।

রাতুল আহমেদ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পিন্টু-তাজুলেরই আরেক ভাই।

হারিছ চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ঢাকায় পলাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।

এই ছয়জনের মধ্যে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কায়কোবাদ ও রাতুল বাবুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি দুজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এসেছে।

পলাতক বাকি ৯ আসামি হলেন: লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আহমেদ, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সদস্য মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাই।

এদের মধ্যে দুই ভাই মুত্তাকিন ও মুরছালিন জঙ্গি হামলার অভিযোগে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। একই সাজা হয়েছে মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাইয়ের।

এ টি এম আমিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন। তিনি ওই সরকারের মেয়াদ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান বলে তথ্য আছে। এরপর তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি। তার কারাদণ্ড হয়েছে দুই বছরের।

সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারকে নানা সময় কানাডায় দেখা গেছে। তবে এই মামলায় সাজা হওয়ার পর তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য আসেনি। তারও দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

বাকি ছয়জনের অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে।