সাবেক মন্ত্রীসহ ১২ জন অভিযুক্ত ,ক্রেস্ট জালিয়াতিতে সরকারের ক্ষতি ৭ কোটি টাকা

SHARE

download (1)১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বন্ধুপ্রতিম বিদেশী ব্যক্তিত্ব এবং সংগঠনকে সম্মানিত করতে তাদের উপহার দিয়েছে সরকার। এই উপহার তৈরির জন্য যেসব ধাতব পাত কেনা হয়েছিল, সেগুলো কেনার সময় প্রায় ৭.০৪ কোটি টাকা ঠকানো হয়েছে সরকারকে। সংশ্লিষ্ট তদন্ত প্রতিবেদনেই এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

উপহার তৈরির জন্য নিম্নমানের ধাতব পাত কেনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দায়ী হিসেবে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আরো ১২ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

কাঠ, স্বর্ণ এবং রূপা দিয়ে তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলোতে কোনো মূল্যবান ধাতু খুঁজে পাওয়া যায়নি বললেই চলে। উপহার রাখার জন্য তৈরি করা বাক্সগুলোতে আমেরিকার ওক গাছের কাঠ ব্যবহার করা হলেও সেগুলোও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের এবং এরই মধ্যে অনেকগুলো বাক্সই বেঁকে গেছে।

ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমানের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী একেএম মোজাম্মেল হকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

জিল্লার রহমান বলেন, “এই প্রতারণার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোতে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছিল সেগুলোর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ আছে কি-না এবং বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে এর সঙ্গে কারা জড়িত সেটাই খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আমাকে। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি।”

কিন্তু দোষী ব্যক্তিদের কী শাস্তি দেয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে কমিটি কোনো সুপারিশ করেনি কেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এই দায়িত্ব কমিটিকে দেয়া হয়নি।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) উপহারগুলো নিয়ে একটি পরীক্ষা চালিয়েছিল যার ফলাফল নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, ২০১২ সালে করা বিএসটিআই’র এক পরীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে প্রতিটি উপহারে মাত্র ২.৩৬৩ গ্রাম স্বর্ণ এবং ৪৬৬.২৩৭ গ্রাম পিতল ব্যবহার করা হয়েছে।

কিন্তু ২০১২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী এবিএম তাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত উপহার তৈরির চুক্তিপত্রে শর্ত ছিল প্রতিটি উপহার ২২.৫ গ্রাম স্বর্ণ এবং ৩৩৯ গ্রাম রূপা দিয়ে তৈরি করা হবে।

উপহারগুলোতে উন্নতমানের মূল্যবান ধাতু ব্যবহারের জন্য উচ্চমূল্য পরিশোধ করার পরেও বিদেশী বন্ধুদের হাতে শেষ পর্যন্ত নিম্নমানের উপহারই তুলে দিয়েছিল সরকার।

তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তদন্ত কমিটির একটি সূত্র জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টিতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭.০৪ কোটি টাকা। বিদেশী বন্ধুদের জন্য তৈরি করা ৩৩৮টি উপহারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ১১.২ কোটি টাকা খরচ করেছে।

এই উপহারগুলোর মধ্যে মাত্র একটিতে শর্ত মোতাবেক সব ধরনের মূল্যবান পদার্থ পাওয়া গিয়েছে। ওই উপহারটি ছিল ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর।

এই বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে সাবেক মন্ত্রী এবিএম তাজুল ইসলাম জানান, উপহারগুলো তৈরি ও কেনার পুরো বিষয়টি দেখভাল করেছে মন্ত্রণালয়ের ক্রয় কমিটি।

তিনি বলেন, “আমি ওই ক্রয় কমিটির সদস্য ছিলাম না। তাই এই বিষয়ে আমাকে দায়ী করার কোনো কারণই নেই।”

সাবেক এই মন্ত্রী জানান, তার নিজস্ব তত্ত্বাবধানেই ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়া উপহারটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমিই মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছিলাম বাকি উপহারগুলোও পরীক্ষা করার জন্য। ওই পরীক্ষাগুলোর ওপরে কোনো প্রতিবেদ আমি এখনো পাইনি।”

ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়া ১.৪২ কোটি টাকার উপহারটি পরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

৩৩৮টি উপহারের মধ্যে ২৭৮টি অ্যামেকন থেকে এবং বাকি ৬০টি এম/এস মোহাসিনুল হাসান তৈরি করেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অ্যামেকনের তৈরি করা বিলে দেখা গেছে প্রতিটি ক্রেস্টের জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২.৯৪ লাখ টাকা করে পেয়েছে এবং ৬০টি ক্রেস্টের জন্য এম/এস মোহাসিনুল হাসান পেয়েছে ১.৭৯ কোটি টাকা।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বন্ধুপ্রতিম বিদেশী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে এবং বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মানিত করতে ২০০৯ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে সরকার। সাত দফায় সরকার ৩৩৭-এরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এখন পর্যন্ত সম্মানিত করেছে সরকার।

এই ব্যাপারে কথা বলতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী একেএম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের সচিব মিজানুর রহমান, সাবেক সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, অতিরিক্ত সচিব গোলাম মুস্তাফা, যুগ্ম-সচিব আব্দুল কাশেম তালুকদার, উপ-সচিব এনামুল কাদের খান এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব বাবুল মিয়াসহ আরো ১২জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগেই গোলাম মুস্তাফা এবং বাবুল মিয়াকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার জন্য আবুল কাশেম তালুকদারও ওএসডি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।

ওএসডি পদে কাউকে নিযুক্ত করাকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।