উন্নয়ন এজেন্ডায় অভিবাসন ইস্যুকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অর্ন্তভুক্ত করার আহবান প্রধানমন্ত্রীর

SHARE

7685c3ce527ef008474d19f07927ca4d20131119প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডায় অভিবাসন ইস্যুকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অর্ন্তভুক্ত করার আহবান জানিয়ে বলেছেন, প্রত্যেক অভিবাসীকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপাদানের পরিবর্তে একজন মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, “অভিবাসীকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কার্যক্রম বা উৎপাদনের উপাদান হিসেবে দেখলে চলবে না। তাদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। অন্যান্য নাগরিকের মত তাদের জন্যও সকল সুযাগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী আজ রূপসী বাংলা হোটেলে ‘২০১৫- পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডায় অভিবাসন সংক্রান্ত দুদিন ব্যাপী বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞ সভায় ’ এ আহবান জানান। বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের যৌথ উদ্যোগে এই সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ এবং অর্থনীতি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের সাথে সাথে মৌলিক সেবার চাহিদা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। যা বৈশ্বিক মানব স্থানান্তরের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি অভিবাসী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের মত বিষয়গুলো জোরালো হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত পরিবেশ নাজুক এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে –একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য সকল উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই জনগণকে রাখতে হবে। জনগণের মর্যাদা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। যেসব মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমন করছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এএইচএম মোস্তফা কামাল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের আর্ন্তজাতিক অভিবাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিনিধি স্যার পিটার সুথারলেন্ড’র একটি ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনমিতি সংক্রান্ত ‘বৈশ্বিক নেতৃত্ব’ বৈঠকে শেখ হাসিনা উন্নয়নের উপর অভিবাসনের প্রভাব বিষয়ে যে মতামত দিয়েছিলেন তার উল্লেখ করেন। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈশ্বিক জনসংখ্যার পরিবর্তন এবং এর ফলাফলজনিত চ্যালেঞ্জ কীভাবে কল্যাণকরভাবে মোকাবিলা করতে পারে এবং পাশাপাশি অভিবাসন এবং স্থানান্তরের সুফল কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে তখন তিনি তার বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক দেশের মত বাংলাদেশও জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে ২০১৫-পরবর্তী এজেন্ডায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা বা এসডিজিএস এর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অত্যন্তÍ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে, বিশেষ করে, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,“ বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও ৬ শতাংশেরও অধিক হারে আমাদের জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। অতি দরিদ্রের সংখ্যা ২৯ শতাংশে হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ইতোমধ্যেই ৩১ শতাংশ অর্জন করেছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি অভিবাসীদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছেন, অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও নিরাপদ, নিয়মতান্ত্রিক এবং কল্যাণমূলক করা প্রয়োজন। “আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে হবে অভিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি। উৎস এবং গন্তব্য উভয় দেশে অভিবাসন এবং অভিবাসী কর্মীদের ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে হবে। আমাদের জনগণকে বলতে হবে – অভিবাসন সব সমাজের জন্যই একটি প্রয়োজনীয় উপাদান ।”
এক্ষেত্রে তিনি ছয়টি বিষয়ের প্রস্তাব করে বলেন, এগুলো সম্ভাব্য লক্ষ্য এবং সূচক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো হচ্ছে: প্রথমত , ২৫ কোটির কাছাকাছি অভিবাসী আজ বিশ্বব্যাপী কাজ করে, বসবাস করেন অথবা ভ্রমণ করেন। নিজ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। দেশে ফেরার সময় তারা কাজ ও জীবনের যেসব অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং ধ্যান-ধারণা নিয়ে ফিরে আসছেন, তার মাধ্যমেও নিজ দেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
দ্বিতীয়ত, মানুষের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন অবশ্যম্ভাবী। টেকসই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য মানুষের অধিক হারে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগতভাবেই গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত দেশসমূহের জনসংখ্যার দৃশ্যপট পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। একজন অভিবাসী কর্মীকে উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবে দেখতে হবে এবং প্রক্রিয়াটিতে প্রতিটি ব্যক্তির মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, একজন অভিবাসীকর্মী যখন বিদেশে যান, তখন তাকে সামাজিক-আবেগিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বিশেষ করে অভিবাসী নারী এবং বালিকাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি করে প্রযোজ্য। নিজ সমাজেও তাদের বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের জন্য আরও সুন্দর এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
চতুর্থত, বাংলাদেশের মত দেশে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত যুব জনসংখ্যার কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশ্বকে এই প্রশিক্ষণযোগ্য যুব জনশক্তিকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে এশিয়া এবং আফ্রিকার যুব জনসংখ্যাকে জ্ঞান ও দক্ষতা বিষয়ে প্রস্তুত করতে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে আমরা এই বিশালসংখ্যক যুবক এবং যুব মহিলার দ্রুত প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।
পঞ্চমত, ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের সীমাবদ্ধতা এবং সম্পদের অপ্রতুলতা সত্বেও আমরা সহ¤্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সম্পদ ও সামর্থের যোগান দিয়ে যাচ্ছি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সহায়তা প্রদানের জন্য উন্নত দেশগুলোকে আর বেশি করে তাদের অর্থ-জ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সর্বশেষ, ২০১২ সালে রিও-তে অভিবাসীদের সব ধরনের অধিকার প্রদানের বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় ঐকমত্য পোষণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিটি অভিবাসী পুরুষ ও নারীর অধিকারকে সমর্থন দিতে হবে।

 

প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এমন উপায় চিহ্নিত করার আহবান জানান- যাতে অভিবাসন দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখতে পারে, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়, অসমতা হ্রাস করে এবং বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক হয়।
তিনি বলেন, অভিবাসন প্রক্রিয়ায়, অভিবাসীদের বিশেষ করে নারী ও বালিকাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অভিবাসী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য গুণগত মৌলিক শিক্ষা, ভকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও উৎস ও গন্তব্য উভয় দেশে যাতে তারা অবদান রাখতে পারেন, সেজন্য অভিবাসীদের সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক বিষয়ে সহায়তা প্রদান এবং অর্থ প্রেরণসহ অভিবাসীদের সব ধরনের খরচের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই ও সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সঙ্গে এগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আগামী ১৫ বছরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- এসডিজি এস সব দেশের জন্য একটি দূরদর্শী এবং বৈপ্ল¬বিক লক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি মনে করেন, এগুলো সর্বজনীন এবং প্রতিটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও চাহিদা বিবেচনায় সমস্যার সামগ্রিক সমাধান প্রয়োজন।