টেকনিক, স্টাইল সব কিছুতেই কি উত্তমের কাছে হেরেই গেলেন সৌমিত্র?

SHARE

শোনা যায়, দু’টি ঘোড়ার কথা বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরে। বলেছিলেন, এত দিন দু’টি ঘোড়া ছুটত, এখন থেকে একটা ঘোড়া ছুটবে। ঘোড়া, বোঝাই যাচ্ছে, কারা– উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজে। দৌড়ের মাঠটি টলিপাড়ার বাংলাছবি। পরে কোথাও কোথাও সৌমিত্র প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন যে, তিনি এ-জাতীয় কথা বলেননি।

কিন্তু এ সৌমিত্র বলুন আর না-ই বলুন– সম্ভবত বাংলাছবির আমদর্শকদের মনের কথা অনেকটা এ জাতীয়ই। এ বাক্য তিনি উচ্চারণ করুন বা না করুন, স্বয়ং সৌমিত্রের নিভৃত মনোভাবও নিঃসন্দেহে এমনই। কেননা, একাধিকবার বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেছেন, সামনে উত্তমকুমার ছিলেন বলে তিনি আরও ভাল অভিনয় করার প্রেরণা পেতেন।

শুধু প্রেরণা? আচ্ছা, তা-ই না-হয় ধরে নেওয়া গেল। কিন্তু এ তো গেল, পোশাকি গুণমুগ্ধতার সৌজন্যগন্ধী নিরামিষ উচ্চারণ। উত্তমকুমারের সেই অপার বিপুল সাম্রাজ্যে তিনি কি ভাগ বসাতেও চাননি? চাননি, ছবির পর ছবিতে ওঁর মতোই ওই অলৌকিক দ্যুতি ছড়াতে? স্পষ্ট করে কখনও এই আমিষ তিনি বলেননি। বরং বোঝাতে চেয়েছেন, নিছক স্টারডমকে তিনি একটু নীচু নজরেই দেখে থাকেন। কারণ তিনি ‘আম’ নন, তিনি ‘ক্লাস’। তিনি হিরো নন, তিনি অভিনেতা। তিনি শুধু নায়ক নন, তিনি চরিত্র।

সত্যি; অথচ পুরো সত্যিও হয়তো নয়।

পর্দার মহানায়ককে দেখে সিনেমা হলের অতলান্ত অন্ধকার থেকে উঠে আসা ‘গুরু! গুরু!’ ধ্বনিকে না-হয় প্রত্যাখ্যান করলেন সৌমিত্র (বাস্তবিকই অতি কঠিন, সৌমিত্র আদৌ তা করেছেন কিনা তা নিয়েও ফিল্মবাফরা গভীর চর্চা করতে পারেন; তিনি পারেননি এটা যদি একটু ‘হার্ডহিটিং’ হয়েও যায়, তা হলেও এত দিন পরে এ বার খাঁটি সত্য সন্ধান করাই বোধ হয় উত্তম)! কিন্তু উত্তমের নিছক গ্ল্যামারকণ্টকিত ছবিগুলি আলোচনা থেকে যদি বাদও দেওয়া হয়, তা হলেও তাঁর চার দশকের ফিল্মজীবনে পূর্বাপরহীন যে-সব আশ্চর্য মণিমুক্তো রুপোলি পর্দায় ছড়ানো আছে, তার দুর্বহ ম্যাজিক-রিয়্যালিজম থেকে সত্যিই কি কখনও মুক্তি পেয়েছেন অভিনেতা-সৌমিত্র? প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিস্পর্ধী একজন শিল্পী কি সত্যিই এ থেকে মুক্তি নিতে পারেন, মুক্তি পাওয়া যায়?

সৌমিত্র নিজে ন’টি ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার মধ্যে বাঙালির মনের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছে তিনটি ছবি– ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘স্ত্রী’, ‘দেবদাস’! এর ঠিক পরে পরেই সম্ভবত থাকবে ‘অপরিচিত’, ‘যদি জানতেম’, ‘দর্পচূর্ণে’র মতো ছবি। উত্তমের অতি বড় শত্রুও (পড়ুন না-ভক্ত) বলবে না, এই ছবিগুলিতে সৌমিত্র উত্তমকুমারকে অতিক্রম করে গিয়েছেন। বরং সকলেই একবাক্যে বলেন, বলবেন, ব্রিলিয়ান্ট অভিনয় করে সৌমিত্র আগাগোড়া উত্তমকে ফাইট দিয়ে গিয়েছেন!