বাবরি মসজিদের নীচে মন্দির ছিল? বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক

SHARE

গতকাল শনিবার ভারতের বহুল আলোচিত বাবরি মসজিদ মামলার রায় দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। রায় দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ধর্মীয় বিশ্বাস, বা জনতার আবেগের ভিত্তিতে নয়, রায় দেওয়া হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। ২০০৩ আগস্টে এএসআই–এর ৫৭৪ পাতার এই রিপোর্ট জমা পড়েছিল এলাহাবাদ হাইকোর্টে। সেখানে বলা হয়েছিল, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে মসজিদের নিচে, মাটির গভীরে প্রাচীনতর এক ইমারতের অবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু তা আদতে কোনও মন্দির কি না, সে সম্পর্কে এএসআই–এর বিশেষজ্ঞ পুরাতাত্ত্বিকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। মন্দিরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত নয়। এমনও হতে পারে, যে সেটা আরও পুরনো কোনও মসজিদেরই ধ্বংসাবশেষ।

এএসআই অযোধ্যার জমিতে যখন খনন করেছিল, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের পক্ষ থেকে দুই পুরাতাত্ত্বিক সুপ্রিয়া ভার্মা এবং জয়া মেনন পর্যবেক্ষক হিসেবে তখন উপস্থিত ছিলেন। ২০১০ সালে ‘‌ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে তাঁরা জানান, কেন তাঁরা এএসআই–এর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। এর সব চেয়ে বড় কারণ, তাঁদের মনে হয়েছিল, এএসআই–এর কিছু পুরাতাত্ত্বিক এমন এক পূর্বসিদ্ধান্ত নিয়েই খননের কাজ শুরু করেছিলেন যে মসজিদের তলায় মন্দিরই আছে। তঁাদের কাজ সেটাই খুঁজে বের করা। যে পুরনো পদ্ধতিতে তখন কাজ করেছিল এএসআই, সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন ভার্মা এবং মেনন। তার পরেও যে আদালতে এএসআই–এর রিপোর্টটি কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি, তার কারণ সম্ভবত ভারতে যে কোনও পুরাতাত্ত্বিক কাজ করার ক্ষেত্রে এএসআই–এর সর্বময় কর্তৃত্ব। কোনও নিরপেক্ষ দ্বিতীয় পক্ষ কোনও পুরাতাত্ত্বিক সত্য যাচাইয়ের জন্য ভারতে কোথাও খনন করতে চাইলে আগে এএসআই–এর অনুমতি নিতে হয়। সেই কর্তৃত্বও বিনাপ্রশ্নে স্বীকৃত। তার বাইরের কেউ তাই এএসআই–এর গবেষণার পদ্ধতি বা ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলে না।

কিন্তু কেন প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল, সেই যুক্তি দিয়েছেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সুপ্রিয়া ভার্মা। এক, মসজিদের নিচে মন্দিরের অস্তিত্বের পক্ষে এএসআই পশ্চিমের দেওয়ালের কথা বলেছে। কিন্তু ভার্মার যুক্তি, মন্দিরে নয়, বরং মসজিদেই পশ্চিমদিকে দেওয়াল থাকে, যার সামনে নমাজ পড়া হয়। মন্দিরের গঠনশৈলী আলাদা হয়। পশ্চিমে দেওয়াল থাকাটা সেখানে আবশ্যিক নয়। দুই, পঞ্চাশটি স্তম্ভ দিয়ে তৈরি এক ভিতের কথা বলেছে এএসআই, যা নাকি মন্দিরের অবশেষ। ভার্মা বলছেন, এই দাবি ঠিক নয়। একাধিকবার আদালতকে জানানো হয়েছিল, যে এএসআই যেগুলোকে ভাঙা স্তম্ভ বলছে, সেগুলো আসলে জমে থাকা ইট, যার ভেতরে মাটি জমা হয়ে ছিল। তিন, এএসআই ১২টি ভাঙা টুকরো নমুনা হিসেবে দেখিয়েছে, যা নাকি ভাঙা মন্দিরের অংশ। ভার্মা যেহেতু খননের সময় আগাগোড়া হাজির ছিলেন, তিনি দাবি করছেন, ওই ভগ্নাংশগুলি একটিও মাটি খুঁড়ে পাওয়া নয়। বরং মসজিদের মেঝেতে জমে থাকা ধ্বংসস্তূপ থেকে ওগুলি সংগ্রহ করা হয়েছিল। মন্দিরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে যা আদৌ যথেষ্ট নয়। সত্যিই কোনও মন্দির ভাঙা হয়ে থাকলে অনেক বেশি নমুনা পাওয়া যাওয়ার কথা। মাত্র ১২টি নয়।
অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমিতে তার আগেও যে খনন হয়েছিল, তার উল্লেখ করেছেন সুপ্রিয়া ভার্মা। প্রথমবার ১৮৬১ সালে। এএসআই–এর প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম–এর তত্ত্বাবধানে সেই খনন হয়। ওই জমির নিচে তিনটি ঢিবির সন্ধান পায় এএসআই, যার দুটি আকারে বৌদ্ধ স্তূপের মতো এবং তৃতীয়টির আকৃতি বৌদ্ধ বিহারের ধাঁচের। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে কানিংহ্যাম জেনেছিলেন, ওই অঞ্চলে কিছু মন্দিরও ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ না মেলায় তিনি চূড়ান্ত রিপোর্টে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এর পরের খনন ১৯৬৯ সালে, করেছিল বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ। বাবরি মসজিদের লাগোয়া জমিতে সেই খননে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যে মধ্যযুগে, এমনকী সম্ভবত নথিভুক্ত ইতিহাসেরও আগের সময়ে ওই এলাকায় জনবসতি ছিল। এর পর, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ওই একই জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করেন এএসআই–এর তৎকালীন অধিকর্তা বি বি লাল। তঁার অনুসন্ধান আগে পাওয়া তথ্যকে আর খুব বেশি পুষ্ট করতে না পারলেও তঁার কাজের এক অন্যতর গুরুত্ব আছে।

১৯৮৮ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যা, মথুরা এবং বারাণসী, এই তিন জায়গায় হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে শোরগোল শুরু করে। সেই বছরই বি লাল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ‘‌মন্থন’ পত্রিকায় নিজের একটি লেখায়, বাবরি মসজিদের ভিতের কাছে সারিবদ্ধ ‘’স্তম্ভ’‌–র ছবি দিয়ে জানান, ৭৫ থেকে ৭৮ সালের মধ্যে যে খনন হয়েছিল, তখনই তিনি এই স্তম্ভগুলির ছবি তোলেন। ওই বছরেই ক্রোয়েশিয়ায় বিশ্ব পুরাতত্ত্ব কংগ্রেসে তিনি ওই একই ছবি দিয়ে দাবি করেন, বাবরি মসজিদের জমি খুঁড়লে মাটির তলায় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে। এর পরই বিজেপি রামমন্দিরের ইস্যুটি হাতে নেয়, ক্রমশ মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়।
১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় আসে এনডিএ এবং রামমন্দির আন্দোলন আরও জোরদার হয়। ২০০২ সালে এএসআই–কে আবারও খননের নির্দেশ দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট।

২০০৩ সালে হাইকোর্টে জমা পড়া এএসআই–এর রিপোর্ট সম্পর্কে সু্প্রিয়া ভার্মা বলছেন, এতে আরও তিনটি বিষয় আলাদাভাবে নজর করা উচিত। এক, অযোধ্যার ওই জমি খুঁড়ে একাধিক নরকঙ্কালের অবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। চূড়ান্ত রিপোর্টে তার কোনও উল্লেখ নেই। দুই, রিপোর্টের প্রতিটি পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে, কোন পুরাতাত্ত্বিক সেই অংশটি লিখেছেন। রিপোর্টের শেষ পরিচ্ছেদে কিন্তু কারও নাম নেই। এবং তিন, পশ্চিমের দেওয়াল এবং ৫০টি স্তম্ভের অবশেষের কারণে মসজিদের নিচে হিন্দু মন্দির থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে আক্ষরিকভাবেই মাত্র তিন লাইনে। বাকি রিপোর্টে কিন্তু মন্দিরের কোনও উল্লেখ নেই। ‌