ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে ক্লাবগুলোর অস্তিত্ব সংকট

SHARE

মাঠে খেলা অনিয়মিত। সাফল্য আরো অনিয়মিত। ক্রিকেটের জাতীয় দল বাদে অন্য খেলাগুলোর দর্শক নেই। যে ক্লাব সংস্কৃতির উপর বেঁচে থাকে দেশের ক্রীড়াঙ্গন, তাতে পচন বেশ আগেই। দুঃসহ দীর্ঘকাল ধরে তাই ধুঁকছিল বাংলাদেশের ক্রীড়া-ক্লাবগুলো।

তবু তো টিকে ছিল। কিন্তু এবারের যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, তাতে ক্লাবগুলোর অস্তিত্বই সংকটের মুখে। আগামী মৌসুমে খেলা মাঠে গড়াবে কিনা, তা নিয়ে এখন ঘোর সংশয়।

ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্র খেলাধুলার কারণে সংবাদ শিরোনামে আসে না বহুকাল। এবার পুরো দেশ কাঁপিয়ে গণমাধ্যমে ক্লাবগুলোর সরব উপস্থিতি। আর সেটি কী ন্যাক্কারজনক কারণে! আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম। এরপর অভিযান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টি ক্লাব এমনকি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে পর্যন্ত। এখানেই শেষ নয়। চট্টগ্রামের আবাহনী লিমিটেড, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও চলে একই রকম অভিযান।

তাতে প্রমাণ মেলে, ক্লাবগুলো মাঠের খেলা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিল জুয়ার আখড়া। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ক্রীড়া ক্লাবগুলোর এই ক্যাসিনো ক্লাবে রূপান্তর সংগঠকদের প্রশ্রয়ে; তাঁদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

খেলোয়াড়-কোচ-সংগঠক হিসেবে ক্লাবের সঙ্গে নিজের জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন ফুটবলের গোলাম সারোয়ার টিপু। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন, ‘‘আমার বয়স এখন ৭৫ বছর। এর মধ্যে ৫০-৬০ বছর তো খেলার সঙ্গে, ক্লাবের সঙ্গেই কাটিয়ে দিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের ক্লাবগুলো এমন সংকটে কখনো পড়েছে বলে আমার মনে পড়ে না।’’ তাঁর পরিচয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নামও এ কেলেঙ্কারিতে যোগ হওয়ায় ক্ষুব্ধ টিপু, ‘‘আমি আবাহনীতে খেলেছি। ওদের প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবার কাছে আমি ‘মোহামেডানের টিপু’। এখন তো সেই পরিচয় সংকটেই পড়ে গেছি। মোহামেডানের টিপু পরিচয়টা দিতে এখন আমি লজ্জিত বোধ করছি; অপমানিত বোধ করছি।’’

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন কাজে উল্টো ক্রোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের এক ক্লাব কর্মকর্তা। ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয়ের কোনো জায়গা নেই, অনুদানের ভিত্তিতে তা পরিচালিত হয় বলে জানিয়েছেন। ক্যাসিনো বা জুয়াবোর্ডের অর্থ থেকে খেলোয়াড়দের টাকা দেয়া হয় বলেও বুঝিয়ে দেন প্রচ্ছন্নে। কিন্তু সেটি তো আর ক্রীড়াক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর বৈধতার ছাড়পত্র হতে পারে না। আর এখানকার অর্থের কত শতাংশ খেলোয়াড়রা পান; বিপরীতে কিভাবে ফুলেফেঁপে ওঠেন ভুঁইফোঁড় ক্লাব কর্মকর্তারা। সেটিও কারো অজানা নয়।

ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয় নেই; সত্যি। অনুদানের ভিত্তিতে ক্লাবগুলো চলে; সত্যি। কিন্তু বাংলাদেশে এ বাস্তবতা তো চিরকালীন। তবু কি অতীতে নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকরা নিজেদের মতো অর্থ সংস্থান করে ভালোবাসার ক্লাব চালাননি? তেমনই এক উদাহরণ দেন গোলাম সারোয়ার টিপু, ‘‘আমাদের সময়ের সংগঠকরা বউয়ের গয়না বিক্রি করে ক্লাব চালাতেন। আমার মনে আছে, মোহামেডান ক্লাব একবার অর্থ সংকটে পড়ল। আমান ভাই নামের এক সংগঠক ফুটবলের দলবদলের সময় নিজের গাড়ি বিক্রি করে দিলেন খেলোয়াড় কেনার জন্য। এখন তো এটি গাঁজাখুরি গল্পের মতো শোনাবে। কারণ, এখনকার সংগঠকরা ক্লাবকে ব্যবহার করে বিপুল বিত্তশালী হয়ে উঠছেন। নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য, লোভের জন্য এখানে ক্যাসিনো পর্যন্ত চালাতেন, ভাবা যায়!’’

৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্লাব সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। ক্যাসিনো-কাণ্ডে তিনিও ভীষণ বিব্রত। অবৈধ অর্থের মালিকদের ক্লাবে প্রবেশকে এর কারণ হিসেবে দেখেন তিনি, ‘‘আগে ক্লাবের কার্ডরুমে কার্ড খেলা হতো। সেটি নির্দোষ বিনোদন। ক্লাব সদস্যরাই অংশ নিতেন কেবল। সেখান থেকে অল্প যে কিছু টাকা উঠত, তা দিয়ে ক্লাবের বল কেনা কিংবা চা-নাস্তা কেনার মতো টুকটাক কাজে ব্যয় হতো। পরবর্তীতে ক্লাবের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখানে প্রবেশ করেন কালো টাকার মালিকরা। ক্লাবের সুনাম ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেন তারা। সেটি করতে করতে এভাবে যে ক্যাসিনোর সংস্কৃতিতে ঢুকে যাবে ক্লাবগুলো, তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না।’’

সাম্প্রতিক এ কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। কিভাবে? হাহাকার ছড়ানো কণ্ঠে গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন, ‘‘দেখুন, বাংলাদেশে ক্রিকেট বাদে অন্য সব খেলার খেলোয়াড় এখন কমে গেছে। তবু তো কিছু ছেলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় ফুটবল খেলতে আসে, ক্রিকেট খেলতে আসে, হকি খেলতে আসে। খুলনা থেকে, কুমিল্লা থেকে, নীলফামারি থেকে যে ছেলেটি খেলার স্বপ্ন নিয়ে ক্লাবতাঁবুতে এসে ওঠে, সে কী পরিবেশ পাচ্ছে? পাচ্ছে জুয়ার পরিবেশ; ক্যাসিনোর পরিবেশ। ওখানেই তো সব শেষ। মা-বাবারা কেন তাঁদের সন্তানকে এমন পরিবেশে পাঠাবেন?’’

নির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস না থাকা বাংলাদেশের ক্রীড়া-ক্লাবগুলো চলে অনুদানের ভিত্তিতে। ক্যাসিনো-কাণ্ড প্রকাশ্য হওয়ায় এবার সে জায়গা সংকুচিত হবে; সামগ্রিক অর্থেই তাই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ঘোর দুর্দিনের আশঙ্কা টিপুর, ‘‘এতদিন আমাদের ক্লাবগুলোর ক্রীড়ায় সাফল্য ছিল না। এবার যোগ হলো বদনাম। এখনো যে অল্পসংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক রয়েছেন, তারা কি ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে এ বদনামের ভাগীদার হতে চাইবেন? চাইবেন না। বসুন্ধরার মতো বড় প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ক্লাব চালায়। অমন বড় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে এই ক্যাসিনো-লজ্জার ভাগ হতে চাইবে? চাইবে না। আগামী মৌসুমে ক্লাবগুলো তাই কিভাবে ফুটবল-হকি-ক্রিকেটসহ সব খেলার দল গঠন করবে, সেটি ভেবে পাচ্ছি না। খেলা মাঠে গড়ায় কিনা, তা নিয়েও আমার সন্দেহ।’’

তবে এই ঘোর অন্ধকারেও সম্ভাবনার সূর্যরশ্মি দেখছেন আবাহনী ক্লাবের সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, ‘‘সময়টা অবশ্যই খারাপ। তবে এই খারাপ থেকে ভালো কিছুও হতে পারে। ক্লাবগুলোর আয়ের নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করতে হবে। সরকার, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মিলে সেটি করা সম্ভব। তাহলে কালো টাকার মালিকরা এখানে আসতে পারবেন না। ক্লাবগুলো যদি বিত্তশালী কালো টাকার মালিকদের হাতে জিম্মি না হয়ে সত্যিকার সংগঠকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এ দুঃসময় কেটে যাবে।’’

আর তা যদি না হয়, তাহলে বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের জন্য অপেক্ষা করছে প্রলম্বিত দুঃস্বপ্ন।