প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং প্রযুক্তি ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পরিচালিত করার জন্য জাতীয় এই টেলিভিশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিটিভিকে অবশ্যই জীবন-ঘনিষ্ঠ অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। শুধুমাত্র সংবাদ জানানোর মধ্যেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। জাতীয় টেলিভিশনকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে হবে যা জনগণের রুচি ও আচরণের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।’
প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠানের সপ্তাহব্যাপী সূবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার বিটিভিকে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। তাই নতুন প্রযুক্তি ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী অনুষ্ঠান নির্মাণকালে বিষয়টি মনে রাখতে হবে।
দেশের প্রধান জাতীয় সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিভি’র দায়িত্বশীলতা অপরাপর বেসরকারি চ্যানেলের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেসরকারি চ্যানেলগুলো তাদের ব্যবসাকে প্রাধান্য দেয়, অন্যদিকে বিটিভিকে জনগণের চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বিটিভির অনুষ্ঠান নির্মাণে মেধাবী, সৃষ্টিশীল ও কর্মদক্ষ ব্যক্তিদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতউল্লাহ এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তথ্য সচিব মরতুজা আহমেদ।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- এশিয়া-প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের মহাসচিব ড. জাভাদ মোতাগহি এবং বিটিভির মহাপরিচালক আবদুল মান্নান।
প্রধানমন্ত্রী বিটিভি সদর দপ্তরের নবনির্মিত ১২ তলা ভবন উদ্বোধন করেন এবং সূবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বেলুন এবং ডাকটিকেট অবমুক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে প্রখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসি রহমান এবং বিটিভির সাবেক ডিজি জামিল চৌধুরীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বিটিভি’র জন্মলগ্ন থেকেই এখানে যুক্ত হয়েছেন অনেক মেধাবি ও সৃজনশীল নির্মাতা, শিল্পী, নাট্যজন এবং কলাকুশলী। এক সময় বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং শিল্পাঙ্গনের প্রায় সকলেরই বিচরণক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। তার প্রমাণ আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী।
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। তার নির্দেশনায় আধুনিক প্রযুক্তি-সম্বলিত রামপুরার এই ভবনে বিটিভি স্থানান্তর হয় ১৯৭৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। ওই বছর মে মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে এই ভবন পদির্শন করেন।
তিনি বলেন, এই ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিটিভি’র চারজন অকুতোভয় কর্মকর্তার স্মৃতি। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর তথাকথিত বিপ্লব দিবসের নামে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়, তেমনি এই ভবনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বিটিবি’র চার কর্মকর্তাকে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের পঞ্চাশ বছর পূর্তির এই শুভক্ষণে আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার করে আমরা জাতিকে কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবো, ইনশাআল্লাহ।
শেখ হাসিনা বলেন, অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসক জিয়া শুধু স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার-আলবদরদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেনি, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অদর্শকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য পরিকল্পনা নিয়েছিল।
তিনি বলেন, জিয়াসহ ’৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসকেরা বিটিভিকে ব্যবহার করেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির হাতিয়ার হিসেবে। জাতীয় সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান বিটিভি-বেতারে জাতির পিতার নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী শ্লোগান জয়বাংলা নিষিদ্ধ করে। রাজাকার, আল-বদর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইত্যাদি শব্দগুলো উচ্চারণ করা যেতো না। স্বাধীন বাংলা বেতারের জাগরণী গানগুলো বিটিভি’তে নিষিদ্ধ ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধী, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে লাখো শহীদের রক্তে রাঙা জাতীয় পতাকা তুলে দেয়। বিটিভি’কে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায়।
তিনি বলেন, ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা এই মিথ্যাচার বন্ধের উদ্যোগ নেই। স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে বিটিভি’কে তার জাতীয় দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিই।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং আদর্শ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের জাতীয় সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার কারণে।
তিনি বলেন, কৃষির উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিভাহ রোধ, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ রক্ষা, সামাজিক-গণসচেতনতা সৃষ্টিসহ ও নানা উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বিটিভি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এসব অনুষ্ঠান তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জঙ্গিবাদ নির্মূল এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে জনমত সৃষ্টিতেও বিটিভি’র ভূমিকা প্রশংসনীয়।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, একটা সময় ছিল বিটিভিই ছিল একমাত্র অডিও-ভিজ্যুয়াল সম্প্রচার মাধ্যম। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরাই প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন সম্প্রচারের দুয়ার খুলে দিই। তিনি বলেন, গত ৬ বছরে আমরা ৩১টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছি। পাশাপাশি ২৪টি এফএম বেতার কেন্দ্র স্থাপনেরও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে কম্যুনিটি রেডিও পরিচালনার অনুমতি দিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাস করি। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিচ্ছি। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তথ্য কমিশন। জাতীয় সম্প্রচার আইন এবং জাতীয় সম্প্রচার কমিশন আইন প্রণয়নের জন্য সম্প্রতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি থেকে ‘সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নামে একটি পৃথক চ্যানেল চালু করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ৩৮ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিটিভি সদর দফতর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৫৪ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের সম্প্রসারিত ভবনের স্টুডিও যন্ত্রপাতি স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে, যা আমি আজ উদ্বোধন করলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারের সময় বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল টেলিস্ট্রিয়াল ও স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশনসহ এই কেন্দ্রকে একটি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রে রূপান্তরের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। বিটিভি’র বার্তা বিভাগের জন্য নতুন ক্যামেরা, কম্পিউটার, এডিটিং প্যানেল, যানবাহন ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যে সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য ২টি বুলেটিন ইশারা ভাষায় উপস্থাপিত হচ্ছে।
তিনে বলেন, টেলিভিশনের পাশাপাশি আমরা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ৩ এপ্রিলকে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন কার্যক্রমকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করায় রেয়াতি শুল্কে মালামাল আমদানিসহ ঋণ বুবিধা এবং ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির সুবিধা পাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম সিটি এবং ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএফডিসিকে আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএফডিসিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি স্থাপনের কাজ শেষের পথে।
তিনি বলেন, গত বছর আমরা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট আইন প্রণয়ন করেছি। এই আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট। অস্থায়ীভাবে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট ভবনে গত ১ নভেম্বর হতে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর আমি প্রথম কোর্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আর্থ-সামাজিক সূচকগুলোর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাই তার বড় প্রমাণ। আমরা যেমন এগিয়ে যাচ্ছি, তেমনি আমাদের সামনে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠত করবো, ইনশাআল্লাহ। আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের মুখ হাসি ফোটাবো এটাই আমাদের লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, বিটিভিকে সক্ষমতা অর্জন করে আমাদের এই চলার পথকে মসৃণ করতে হবে। বিটিভি ভবিষ্যতে আরো আধুনিক গণমাধ্যম হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে জনগণের আকাঙ্খা পূরণে এগিয়ে যাক, এই প্রত্যাশা করছি।– বাসস