এফআর টাওয়ারের আগুন নেভাতে কেন এতো সময় লাগলো?

SHARE

বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টার পরে আগুন আয়ত্তে আনে দমকল বিভাগ। পুরোপুরি আগুন নেভাতে সময় লাগে আরো কয়েক ঘণ্টা।

বিশেষ করে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর আগুন নেভানোর কার্যক্রম শুরু করা, একপর্যায়ে পানি ফুরিয়ে যাওয়া এবং মানুষজনকে উদ্ধার কার্যক্রমে সময় লাগা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন।

ঢাকার বনানীর মতো একটি অভিজাত এলাকায় একটি বহুতল ভবনে লাগা আগুন নেভাতে কেন এতো সময় লাগলো?

বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার খবর দমকল বিভাগ পায় বেলা সাড়ে ১২টা ৫৫ মিনিটে। তাদের হিসাবে এর অন্তত ২০মিনিটি আগে আগুন লেগেছে।

আগুন লাগার চার ঘণ্টারও বেশি সময় পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

পরে এ কাজে দমকল বাহিনীর ১৭টি ইউনিট কাজ করে। সেই সঙ্গে যোগ দেয় অন্যান্য বাহিনীও।

পরে তাদের সাথে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে কাজ শুরু করে। সাথে স্থানীয় মানুষেরাও যোগ দেন।

কিন্তু কেন এই আগুনটি নেভাতে চারঘণ্টা সময় লাগলো?
দমকল বাহিনীর ঢাকা বিভাগের কর্মকর্তা দেবাশীষ বর্ধন জানিয়েছেন, মূলত দুটি কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।

• পানির অভাব

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রচুর পানি দরকার হয়। এক সময় পানির যোগান এবং তা যথাস্থানে দ্রুত সময়ে পৌঁছানো একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশি সময় লাগার এটি একটি কারণ।

কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের বহুতল ভবনের নিচে পানির রিজার্ভ থাকার কথা। কিন্তু ভবনটিতে পানি সরবরাহের যেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না, আশেপাশেও তেমন পানির উৎস ছিল না।

• সিনথেটিক ফাইবার

মি. বর্ধন জানিয়েছেন, ঐ ভবনের বেশিরভাগ তলায় রয়েছে বিভিন্ন অফিস, যেগুলো ডেকোরেট বা সজ্জার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সিনথেটিক ফাইবার। এসব জিনিসে আগুন লেগে যাওয়ায় তা যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি অনেক ধোয়ার সৃষ্টি হয়।

• মানুষের অতিরিক্ত ভিড়

দমকল বিভাগের পরিচালক এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলছেন, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, এ ধরনের বহুতল একটি ভবনের অন্তত ৩০ মিনিট নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ক্যাপাসিটি থাকতে হবে। কিন্তু বনানীর ওই ভবনে সেটা ছিল না। ওই ক্যাপাসিটি থাকলে আগুনটা এতো বড় করে ছড়িয়ে পড়তে পারতো না, দমকল কর্মীরা গিয়েই সেটি নিভিয়ে ফেলতে পারতো।

তিনি জানান, আগুন লাগার বেশ খানিকক্ষণ পরেই দমকল বিভাগে খবর দেয়া হয়েছে। তারপরে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে উদ্ধার কর্মীরা আরো বিপদে পড়েছেন। গাড়ি ঢুকতে সমস্যা হয়েছে, পানি আনা যায়নি।

যেসব কারণে আগুন এতো দ্রুত ছড়িয়েছে

আগুন কেন এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল তা নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ আনসারির সাথে আলাপকালে মূলত ছয়টি কারণ উঠে এসেছে।

১. প্রশিক্ষিত লোকজন ছিল না

তিনি বলছেন, যেকোনো ভবনে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম থাকার পাশাপাশি সেগুলো ব্যবহারে দক্ষতা বা প্রশিক্ষিত লোকজনও থাকা দরকার।

‘দমকল বিভাগের আসতে সময় লাগে। তখন প্রতিটি ফ্লোরে কিছু প্রশিক্ষিত ব্যক্তি থাকা দরকার ছিল, যারা তাৎক্ষণিকভাবে আগুনটি নেভাবেন।’

তিনি জানান, এই ব্যাপারটি এই ভবনে একেবারেই ছিল না।”

২. ‘ফায়ার ডোর ছিল না’

মি.আনসারি জানান, এফ আর টাওয়ারে ‘আগুন থেকে বাঁচার সিঁড়ি থাকলেও তা ছিল নগণ্য।’

‘কোনো ফায়ার ডোর ছিল না। ফায়ার ডোর থাকলে তার ভেতরে আগুন ঢুকতে পারতো না।’

৩. মূল সিঁড়ি ও ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি পাশাপাশি

আরেকটি ব্যাপার হলো, মূল সিঁড়ি আর আগুন থেকে নামার সিঁড়ি বা ফায়ার এক্সিট দুইটা পাশাপাশি ছিল বলে জানা গেছে, ‘যা হওয়ার কথা নয়’ বলে মনে করছনে মি.আনসারি।

এর আগে দমকল বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে, ভবনটিতে সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ড থেকে পালানোর জন্য লোহার ফ্রেমে তৈরি সরু একটি সিঁড়ি ছিল ঠিকই – কিন্তু তা ছিল তালাবদ্ধ।

‘ফায়ার এস্কেপ হিসাবে একটি লোহার সিঁড়ি থাকলেও, বিভিন্ন ফ্লোরে সেটি তালাবন্ধ অবস্থায় দেখা গেছে’ – বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন দমকল বিভাগের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাজাহান শিকদার।

৪. এক্সটিংগুইশার থাকলেও ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত লোক ছিল না

বুয়েটের শিক্ষক মি. আনসারি বলছেন, ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও, সেগুলো ব্যবহারে প্রশিক্ষিত লোকজন ছিল না।

৫. হোসপাইপে পানির সংযোগ ছিল না

এছাড়া হোসপাইপ থাকলেও, সেগুলোয় পানির সংযোগ ছিল না বলে জানতে পেরেছেন তিনি।

৬. ফায়ার অ্যালার্ম ছিল না

বনানীর এই ভবনটিতে কোন ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম ছিল না। যার ফলে অনেকেই এটি বুঝে উঠতে পারেননি।

উঁচু থেকে পড়ে মারা যাওয়া কি ঠেকানো যেতো?
বহুতল ভবনে আগুন লাগার পর লাফিয়ে নিচে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য বাতাসের বিশেষ ম্যাট্রেস রয়েছে দমকল বিভাগের। এর ওপর কেউ পড়লে তিনি আহত হলেও হয়তো নিরাপদে উদ্ধার পেতে পারেন।

কিন্তু বনানীর আগুনের ঘটনায় সেসব ম্যাট্রেস ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

দমকল বিভাগের কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার বলছেন, ‘এ ধরনের ম্যাট্রেস আমাদের কাছেও আছে। কিন্তু এখানে আমরা সেটি ব্যবহার করিনি, তার বিশেষ কারণ রয়েছে।’

‘এসব ম্যাট্রেস পাঁচতলা ভবন পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ ছয়তলার বেশি উঁচু নয়, এমন ভবনে আগুন লাগলে, সেখান থেকে কেউ এসব ম্যাট্রেসে লাফিয়ে পড়লে অক্ষত থাকবেন। কিন্তু এর বেশি উঁচু ভবন হলে, সেখান থেকে কেউ লাফ দিলে এসব ম্যাট্রেস সামলাতে পারবে না, ফলে ওই ব্যক্তির ক্ষতি হতে পারে।’

মি. শিকদার বলছেন, ফলে আমরা যদি সেগুলো এখানে দিতাম, অনেকেই সেগুলো দেখে লাফিয়ে নামার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাতে হতাহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতো। এ কারণে বনানীর আগুনে তা ব্যবহার করা হয়নি।

ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে এড়ানো যেতো?

দমকল বিভাগের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ বলছেন, এই ভবনেই যদি চারটা ফায়ার এস্কেপ থাকতো, অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতো, ফায়ার ডোরগুলো থাকতো, তাহলে এখানে কেউ মারা যেতো না।

তিনি বলছেন, আগুনের খবর পেয়ে দমকল বিভাগ তো গিয়ে আগুন নেভাবেই, কিন্তু এ ধরনের বহুতল ভবনগুলোয় নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকলে তাতে প্রাণহানি যেমন হবে না, তেমনি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাও কমে যাবে।

এ কারণে বিল্ডিং কোড মেনে প্রতিটা বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সেখানকার কর্মীদের প্রশিক্ষণের ওপর তিনি জোর দেন।

পাশাপাশি ঢাকায় আরো বেশি ফায়ার স্টেশন বাড়ানো দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বর্তমানে ঢাকা শহরে ১৭টি দমকল স্টেশন রয়েছে, আর সারা দেশে রয়েছে ৪০২টি স্টেশন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা