১৬৭ আসামি পলাতক, তদন্তের আঁচ পেয়ে আরো শতাধিকের চম্পট

SHARE

মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত ৩৭ এবং বিচারাধীন ১৩০ আসামি পলাতক। এ ছাড়া আরো শতাধিক ব্যক্তি উধাও হয়ে গেছে তদন্তের আঁচ পেয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ও বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ওই অপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্যোগ নেই।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দণ্ডিত ৩৭ জন অপরাধী পলাতক আছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩২টি মামলায় মোট আসামি ১৭২ জন। তাদের মধ্যে ৪২ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে। বাকি ১৩০ জন পলাতক।

তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৫০টি নতুন মামলা তদন্ত করছে সংস্থা। এসব মামলায় শতাধিক আসামি তদন্তের কথা জানতে পেরে পালিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বিদেশ পালিয়েছে বলে তদন্ত সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে।

তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, দণ্ডিত, বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলার প্রায় আড়াই শ ব্যক্তি বিদেশে পলাতক। তবে দণ্ডিত ৩৭ জনই বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে পলাতক রয়েছে। আর বিচারাধীন মামলায় যারা পলাতক, তাদের বেশির ভাগই পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে আছে বলে তদন্ত সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে। আবার কেউ কেউ দেশে আত্মগোপন করে আছে।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, ‘রাজাকারদের নজরদারিতে রাখার দায়িত্ব মূলত পুলিশের। যথাযথ নজরদারি না করা অথবা যোগসাজশের কারণে রাজাকাররা পালিয়ে যাচ্ছে। যারা বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়। আমাদের দেশীয় যারা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তাদের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো নয়। টাস্কফোর্স যেমন অকার্যকর ভূমিকা পালন করছে তেমনি পলাতক দণ্ডিত রাজাকারদের দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে তদারকি সেলও অকার্যকর ভূমিকা পালন করছে।’ এসব অপরাধীকে ফিরিয়ে আনতে কুটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ২০ মার্চ টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনি, বিভিন্ন দাগি দণ্ডিত অপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এটি চলমান।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পলাতক। দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে আরো আছে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার (মৃত্যুদণ্ড), কিশোরগঞ্জের হাসেন আলী ওরফে হাসান (মৃত্যুদণ্ড) ও ফরিদপুরের জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকার (মৃত্যুদণ্ড), আলবদর বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জামালপুরের আশরাফ হোসেন, যশোরের সাবেক এমপি শাখাওয়াত হোসেন, শরীয়তপুরের ইদ্রিস আলী সরদার (মৃত্যুদণ্ড), কিশোরগঞ্জের সৈয়দ হোসাইন আলী (মৃত্যুদণ্ড), গাইবান্ধার আলোচিত রাজাকার ঘোড়ামাড়া আজিজ (মৃত্যদণ্ড), মৌলভীবাজারের শামসুল হোসেন তরফদার ও আব্দুর নূর লাল মিয়া, হবিগঞ্জের লিয়াকত আলী (মৃত্যুদণ্ড), ফরিদপুরের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার (আমৃত্যু কারাদণ্ড)।

প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, বিচারাধীন মামলার আসামিদের মধ্যে যারা পলাতক তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নেত্রকোনার পূর্বধলার শেখ মজিদ, কক্সবাজারের মহেশখালীর মৌলভী জাকারিয়া, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের রাজাকার কমান্ডার এ এফ এম ফায়েজুল্লাহ ওরফে আবুল ফালাহ, গাইবান্ধার রাজাকার আব্দুল জব্বার মণ্ডল।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে ১৩০ রাজাকারকে গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশ। এসব আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা জেনেছি, এই রাজাকাররা বিদেশে পলাতক রয়েছে।’

২০১০ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম। দণ্ডিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ কেউ আগেই বিদেশে পালিয়েছে। আবার কেউ তদন্ত শুরু হওয়ার পর বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পালিয়েছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা অপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও এ পর্যন্ত কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে তদন্তকালীন যারা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের একটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে আমরা উপস্থিত হয়ে পলাতক রাজাকারদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাটাই বেশি।’