আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের নির্বাচন

SHARE

দশ বছর পর বাংলাদেশে এই প্রথম একটি নির্বাচন হচ্ছে যাতে অংশ নিচ্ছে দেশটির সব প্রধান রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কৌতূহল যেন এবার তুলনামূলকভাবে কম। বিভিন্ন দেশের নামকরা সংবাদপত্র বা সাময়িকীগুলোতে এবারের এই নির্বাচন নিয়ে খুব কমই প্রতিবেদন বেরিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্যান্য প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোকে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে অতীতে যেরকম তৎপর ভূমিকায় দেখা গেছে, এবারে সেখানে দৃশ্যমান তৎপরতা বলতে গেলে অনেক কম। বাংলাদেশের এই নির্বাচনকে কীভাবে দেখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়? বিভিন্ন প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিক্রিয়া সংকলন করেছে বিবিসি।

দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, ব্রিটেন

কয়েকদিন আগে ব্রিটেনের ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এশিয়া এডিটর এডাম উইথনালের লেখা এই প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হচ্ছে বিরোধী দলের কর্মীদের জন্য এক ধরনের ভয়ের পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশের এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

এতে বলা হয়েছে, গত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগ ক্রমশ কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের দিকে ঝুঁকেছে এবং কঠোরভাবে বিরোধীদের দমন করেছে, আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ তার অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য পুরো অঞ্চলে সাফল্যের এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। চ্যাথাম হাউজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড: গারেথ প্রাইসকে উদ্ধৃত করে ইন্ডিপেনডেন্ট লিখছে, যেহেতু বাংলাদেশে কোন নির্ভরযোগ্য জরিপ হয়নি নির্বাচনের আগে, তাই বলা মুশকিল ভোটাররা যখন ভোট দিতে যাবে, তখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নাকি তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, কোনটিকে তারা বেশি গুরুত্ব দেবে ।

ড: গারেথ প্রাইস বলেছেন, “এখানে প্রশ্নটা হচ্ছে একজন গড়পড়তা বাংলাদেশি কী ভাবছে। তারা এটা মনে করছেন কিনা যে বর্তমান সরকার দশ বছর সময় পেয়েছে, এখন পরিবর্তন দরকার, নাকি তারা মনে করছেন দলটি বেশ ভালোই চালাচ্ছে।”

তিনি মনে করেন, যদি শেখ হাসিনা ভোটে জেতেন, যেটি প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সেখানে কিছু বিক্ষোভ হবে এবং সেগুলো দমন করা হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ভারত

ভারতীয় সাংবাদিক মানস ঘোষ ‘ব্যাটল ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে লেখায় বলেছেন, এই নির্বাচন গত এক দশক ধরে শেখ হাসিনা যেসব নীতি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছেন, সেগুলোর জন্য এক লিটমাস টেস্ট। তাঁর মতে, “শেখ হাসিনার এসব কর্মসূচির ইতিবাচক প্রভাবই পড়া উচিৎ নির্বাচনে, কিন্তু ‘এন্টি ইনকামবেন্সি’, অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, বিশেষ করে তার দলের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি তার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের বেলায় তার বিরোধী পক্ষ বিএনপির ভাবমূর্তি আরও বেশি খারাপ।”

মানস ঘোষ আরও লিখেছেন, “বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে তারা একেবারেই ছত্রভঙ্গ। একটি নির্বাচনমুখী দল হয়েও বিএনপি যে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিল, সেটি ছিল তাদের জন্য ‘আত্মহত্যার সামিল।’ তাদের সংগঠন যে কেবল শীতনিদ্রায় চলে গিয়েছে তাই নয়, অনেকেই দল ছেড়েছে এবং সংগঠন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।”

নিকেই এশিয়ান রিভিউ, জাপান

নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কভারেজ দিয়েছে জাপানের একটি সাময়িকী ”নিকেই এশিয়ান রিভিউ।” তাদের গত সপ্তাহের প্রচ্ছদ কাহিনিই ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে, যার শিরোনাম “দ্যা রাইজ এন্ড রাইজ অব বাংলাদেশ।” এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটছে, কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, “শেখ হাসিনা কি এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন?”

প্রতিবেদনে অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সবধরণের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের বিশ্বের অন্যতম এক সাফল্য কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এক দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপরে, দেশটির গার্মেন্টস শিল্প চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে, আর মাথাপিছু আয় ২০০৯ সালের পর থেকে তিন গুনে বেড়ে এখন এক হাজার ৭৫০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। চরম দারিদ্র নেমে এসেছে নয় শতাংশের নিচে।

“এরকম উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে যে সরকারের অধীনে, স্বাভাবিক অবস্থায়, তাদের ব্যাপক সমর্থন থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে গণ বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। শেখ হাসিনার বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, যেভাবে কঠোর হাতে তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন, তা নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দেবে না। প্রতিদিন বিরোধী সমর্থকদের যেভাবে ধরপাকড় করা হচ্ছে এবং তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে তাতে মনে হয় সরকারি দল তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করছে।”

“(আওয়ামী লীগ) অতীতের কিছু নির্বাচনে জোরালো সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলীয় কর্মীরা এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনে সম্ভাব্য কারচুপি এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন। পর পর পাঁচ বছরের দুটি মেয়াদের পর এখন কিছু ভোটারের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু আবার অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, অনেকেই একমত হবেন যে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় (বাংলাদেশের) অধিকতর উন্নয়নের পক্ষে যাবে।”

দ্য মিন্ট, ভারত

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাবন্দী। তাই এবার ভোটের প্রচারে অংশ নিতে পারছেন না। লন্ডন ভিত্তিক লেখক সলিল ত্রিপাঠির একটি বিশ্লেষণ ছেপেছে ভারতের বিজনেস ওয়েবসাইট দ্য মিন্ট।

এতে সলিল ত্রিপাঠি লিখেছেন, “একমাত্র জ্যোতিষী আর জরিপকারীরাই নির্বাচনের ফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং প্রায়শই তারা ভুল প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে বসে ৩০শে ডিসেম্বরের ভোট নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা আমার কাজ নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় ফিরে না আসে, সেটা বেশ অবাক করা ব্যাপার হবে।”

তিনি আরও লিখেছেন, বাংলাদেশি গল্পগাঁথায় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নাকি আলোর পথের শক্তি, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দল আর তাদের বিরোধীরা নাকি অন্ধকারের শক্তি। কিন্তু বাস্তবে আজকের আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বাধীনতাপূর্ব কালের আওয়ামী লীগের মিল খুব সামান্য এবং আওয়ামী লীগ এখন কার্যত দেখতে অনেকটা ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকের বাকশালের চেহারা নিয়েছে। যখন কিনা একদলীয় রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল, অন্যান্য দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিল উচ্ছৃঙ্খল তরুণদের পেশিশক্তি নির্ভর একটি দল।”

দ্য স্ক্রল, ভারত

ফাহাম আবদুস সালাম নামে একজন বিশ্লেষক ভারতীয় এই নিউজ ওয়েবসাইটে প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেটি একটি ”ম্যানেজড ইলেকশন” হতে যাচ্ছে কীনা।

“বাংলাদেশে সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী গত সেপ্টেম্বরে লিখেছিলেন, যদি অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরবর্তী পার্লামেন্টে লজ্জাজনকভাবে একটি সংখ্যালঘু দলে পরিণত হতে পারে। এই অনুমান মোটেই বিস্ময়কর নয়, কারণ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতারাও নিজেদের সমর্থকদের কাছে এরকম আশংকার কথা ব্যক্ত করেছেন। এ থেকে যেটা বোঝা যায় তা হলো বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক মতের লোকজনই মোটামুটি একমত যে একটা ”ম্যানেজড ইলেকশন” ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে জেতা অসম্ভব। আর এ ধরণের একটা ”ম্যানেজড ইলেকশন”, যেটাই সম্ভবত ঘটতে যাচ্ছে, তা ভারতের সহযোগিতা ছাড়া ”ম্যানেজ” করা সম্ভব নয়।”

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যে ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে হতাশা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২১শে ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র এ নিয়ে একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য একটি সংস্থাকে তহবিল দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ভিসা এবং অন্যান্য সহযোগিতা না দেয়ায় এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন্স (আনফ্রেল) নামের এই সংস্থাটি তাদের পর্যবেক্ষণ মিশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।

এই মুখপাত্র তার বিবৃতিতে আরও বলেছেন, “যে কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগে শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশ এবং সমবেত হওয়ার অধিকার থাকতে হবে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে তাদের কাজ করতে দিতে হবে এবং কোন ধরণের সহিংসতা, হয়রানি এবং ভয়ভীতির হুমকি ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে সবাইকে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের অঙ্গীকার রক্ষায় উৎসাহিত করছি যাতে করে বাংলাদেশের সব মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ৩০শে ডিসেম্বররের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের মত প্রকাশ করতে পারেন।”

ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন

ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের মতোই অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে কোন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না। তবে এই নির্বাচন যাতে একটি সত্যিকারের বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য তারা বাংলাদেশের সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন এমপির প্রশ্নের উত্তরে ব্রিটেনের ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিসের একজন জুনিয়র মন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশে তারা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং বহুদলীয় নির্বাচন দেখতে চান। ব্রিটেনের বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা দফতর ইউকেএইড কিছু বেসরকারি সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য সহায়তাও দিচ্ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুটেরেসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য এবং সবার অংশগ্রহণে হয় তা নিশ্চিত করতে।

“সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং নারী সমাজ সহ সব বাংলাদেশি নাগরিক যেন নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। নাগরিক সমাজ এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের তাদের ভূমিকা পালনে যেন পূর্ণ সমর্থন দেয়া হয়।”

মহাসচিব আন্তনিও গুটেরেস এই বিবৃতিতে একটি শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থন পুর্নব্যক্ত করেছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।