জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনে ৭৭ শতাংশ ভোট নিজের ঝুলিতে ভরে ভ্লাদিমির পুতিন কেবল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিতই হননি, তিনি তাঁর হাতে সব ক্ষমতা সংহত করেছেন এবং একজন আধুনিক জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি পশ্চিমের সঙ্গে সংঘর্ষের একটি পথও খুলেছেন, যা কিনা বিপর্যয়কর বলেই প্রমাণিত হবে।
পুতিনের অপকীর্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ায় গণতন্ত্রের যে উত্থান ঘটেছিল, পুতিন তাকে একবারে ধ্বংস করে ফেলেন এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করেন। তাঁর সমালোচনা যাঁরা করেছেন, তাঁরা সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ বা অন্য যে কেউ—হয় নিখোঁজ হয়েছেন বা মারা গেছেন।
সের্গেই স্ক্রিপালের সঙ্গে ঘটা ঘটনার কথাই ধরা যাক। সম্প্রতি সাবেক এই রুশ গুপ্তচর ও তাঁর মেয়েকে যুক্তরাজ্যে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে রাশিয়ার তৈরি বিষাক্ত নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এই হত্যাচেষ্টার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেন, কেননা সের্গেই স্ক্রিপালের বিরুদ্ধে পুতিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ রয়েছে। থেরেসা মে রাশিয়ার কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে না পেয়ে যুক্তরাজ্য থেকে ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেন।
সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর রাশিয়ায় যে মুক্তবাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তা পুতিন গুঁড়িয়ে দেন। এরপর রাশিয়ার পুনরায় কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি দেশের মানুষের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। দেশটিতে দারিদ্র্যের হার বেড়েই চলেছে। মদ্যপান ও অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের ফলে মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতি চারজন রুশ পুরুষের মধ্যে একজন ৫৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যায়। আর রুশ জনগণ সন্তান উৎপাদনেও যাচ্ছে না। কেন তারা তা করবে? তাদের যে কোনো আশাই নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার জীবন যদি এতটাই কষ্টদায়ক হয়, তাহলে পুতিন সেখানে কীভাবে কেন এত জনপ্রিয়তা পেয়েছেন? এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য পুতিন যে হুমকি হয়ে উঠছেন, তা ওয়াশিংটনের নেতাদের কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত?
১৯৯৯ সালে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। অনেক রুশ তখন জানত না কে এই পুতিন। কয়েক মাস পর যখন পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বরিস ইয়েলৎসিনের স্থলাভিষিক্ত হলেন, তখন মাত্র ২ শতাংশ মানুষ তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল। পরে অবশ্য তাঁর প্রতি জনসমর্থন (প্রায় ৮৫ শতাংশ) বেড়ে যায়। ইয়েলৎসিন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করলে পুতিন খুব সহজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।
কিন্তু তিনি কী করে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেলেন? উত্তর হচ্ছে চেচনিয়া দখল করে। তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই বিভিন্ন বোমা হামলার জন্য চেচেনদের অভিযুক্ত করেন। এরপর তিনি চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে ব্যাপক বোমা হামলা চালান। এ ঘটনার পর রুশ জনগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে তাদের নিরাপত্তার জন্য পুতিনের মতো একজন শক্তিশালী মানুষ প্রয়োজন।
‘সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ২০ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’—এক ভাষণে এ রকম কথা বলার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। এরপর ২০০৮ সালে পুতিন ও তাঁর অনুগ্রহভাজন দিমিত্রি মেদভেদেভ রুশ সেনাবাহিনীকে জর্জিয়া দখল করার আদেশ দেন। সেনাবাহিনী জর্জিয়ার ২০ শতাংশ দখল করে নেয়। ফলাফল হিসেবে পুতিনের জনপ্রিয়তা অসম্ভব রকমের বেড়ে যায়। তখন তাঁর প্রতি ৮৮ শতাংশ জনগণের সমর্থন ছিল।
২০১১ ও ২০১২ সালে সরকারের দুর্নীতি ও দুর্বল অর্থনীতির প্রতিবাদে রুশ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। তখন পুতিনের প্রতি জনসমর্থন ছিল মাত্র ৬১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতে পুতিন হঠাৎ করেই রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল দখলের নির্দেশ দেন।
২০১৪ সালের ১৮ মার্চ পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়া দখল করে নেন। তখন তাঁর প্রতি জনসমর্থন বেড়ে ৮৩ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর পুতিন রুশ সেনাবাহিনীকে সিরিয়ায় পাঠান। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, ইরানের আয়াতুল্লাহর এবং হিজবুল্লাহর জিহাদিদের সঙ্গে নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাশিয়া নতুন মহাক্ষমতাধর হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এখন আমাদের এই সম্ভাবনাগুলোর কথা মাথায় রেখে অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে যে তিনি আরও বেশি আক্রমণাত্মক হবেন, আরও সমালোচকদের হত্যা করবেন, সম্ভবত অন্য দেশ দখল করবেন। ওয়াশিংটনকে খুব দক্ষতার সঙ্গে এই হুমকি মোকাবিলা করতে হবে। এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচিত হবে রুশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটা করতে হবে তাদের অপরাধের শাস্তি দেওয়ার জন্য এবং নতুন করে যাতে অপরাধ করতে না পারে।
সম্প্রতি ট্রাম্প যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা ছিল একেবারে সঠিক, তবে যথেষ্ট নয়। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে পুতিনের অনুগ্রহভাজনদের অর্থ ও সম্পদ জব্দ করা। ফলে আমেরিকা ও ইউরোপের ব্যাংক থেকে অর্থ সরানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। শুধু তা-ই নয়, তাদের যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অবশ্যই তাঁর সাক্ষাৎকারগুলোতে ও টুইটে পুতিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরও স্পষ্টভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁর এই ঘোষণা দেওয়া উচিত যে পুতিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। বলা উচিত, পুতিন হচ্ছে অর্থলোভী, ক্ষমতালোভী, ভূমিলোভী।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা এবং সাইবার হামলার হুমকিকে মোকাবিলা করার জন্য ট্রাম্পের এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা। ট্রাম্পের উচিত বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া। বর্তমানে এসব দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুবই দুর্বল এবং রাশিয়া যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে। ট্রাম্পকে এ ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ও ন্যাটোর অন্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসা উচিত।
একজন বিদ্বেষপূর্ণ মার্কিনবিরোধী জার ক্রেমলিনে বসে রয়েছেন আর ষড়যন্ত্র করছেন। কেবল দৃঢ় মার্কিন নেতৃত্বই তাঁকে থামাতে পারবে এবং আমরা তাঁকে থামাবই।