ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে উদ্ধার করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্রলীগ উপাচার্যকে উদ্ধার করেনি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বক্তব্য দেওয়ার পর ‘মন খারাপ’ করেছেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁরা বলছেন, উপাচার্যের আহ্বানে ছাত্রলীগ সেখানে গিয়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন তাদের অস্বীকার করছে।
গতকাল লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘উপাচার্যের আমন্ত্রণে ছাত্রলীগ সেখানে গিয়েছিল।’
ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্রী নিপীড়ন করেছেন—এমন অভিযোগে ঘটনার বিচার চেয়ে গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের তিনটি ফটকের তালা ভেঙে উপাচার্যকে তাঁর কার্যালয়ের
সামনে ঘেরাও করেন একদল শিক্ষার্থী ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা। পরে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা গিয়ে ঘেরাওকারীদের মারধর করে প্রায় চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকা উপাচার্যকে ‘উদ্ধার’ করেন। এতে দুই পক্ষের প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হন।
গত মঙ্গলবারের ঘটনা সম্পর্কে ছাত্রলীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার উপাচার্য ঘেরাওয়ের মুখে পড়লে তিনি ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতাকে ফোন করে তাঁকে উদ্ধার করতে বলেন। উপাচার্য যখন এভাবে ফোন করেন, তখন তো সাড়া দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। সেই শীর্ষ নেতা তখন ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলেন। তিনি মুঠোফোনে অন্য নেতাদের জানালে তাঁরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে নেতা-কর্মীদের একত্র করে রেজিস্ট্রার ভবনে উপাচার্যের কার্যালয়ে যান। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি দল অবরুদ্ধ ভিসিকে উদ্ধারে ভেতরে যান। তাঁরা ভিসিকে নিরাপদে উদ্ধারের পর সংঘর্ষ শুরু হয়।
তবে সেখানে উপাচার্যকে উদ্ধারে ছাত্রলীগ যায়নি বলে গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মন খারাপ করার কথা জানিয়েছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। কেন ছাত্রলীগকে ডাকা হলো—প্রশ্নের জবাবে বুধবার প্রক্টর বলেন, সেখানে (মঙ্গলবার) ছাত্রলীগের কেউ ছিল না।
অথচ মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে গতকাল দুপুরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পিতৃতুল্য শিক্ষক তথা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সম্মানিত উপাচার্য মহোদয়ের সম্মান রক্ষা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমি বিশ্বাস করি। একজন মানুষ হিসেবে বিবেকের তাড়না থেকেই ছুটে গিয়েছিলাম।…’
এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের একজন নেতা বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে আমরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে পোলাপান খেপে আছে। সবাই দুর্নামের ভাগী হলাম যাদের জন্য, তারাই এখন উল্টে গেল।’
ওই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আন্দোলনকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন বামপন্থী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী। অথচ সব গণমাধ্যমে তাঁদের সাধারণ শিক্ষার্থী বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টা এমন যে ছাত্রলীগের কেউ শিক্ষার্থী নন।
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
এদিকে ‘ছাত্রী নিপীড়ন’ ও ‘উপাচার্যের ওপর আক্রমণের’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উভয় পক্ষ আলাদা কর্মসূচি পালন করেছে। বামপন্থী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের বিচারের দাবিতে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা গতকাল মানববন্ধন করেছেন। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ব্যানারে এই মানববন্ধন হয়। এতে টিএসসিভিত্তিক বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতারা যোগ দেন।
বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এই মানববন্ধনে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন অংশ নেন। পরে আবিদ আল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ডাকা ২৯ জানুয়ারি ধর্মঘট কর্মসূচি গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিহত করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংসদের সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান ওই মানববন্ধনের সমন্বয়ক।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অপরাজেয় বাংলায় আয়োজিত সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়। সেখানে ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ইমরান হাবিব বলেন, হলে উঠতে হলেও ছাত্রলীগ ছাড়া ওঠা যায় না। সবক্ষেত্রেই চলছে তাদের দখলদারি। প্রতিবাদ করতে গেলেই হামলা করা হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যায় ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মহানগর রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজন করে প্রতিবাদী সমাবেশ ও মশাল মিছিল। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, জহরলাল রায়সহ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে এই মশাল মিছিল হয়।
বহুদিন পর ক্যাম্পাসে ছাত্রদল
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গতকাল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। মিছিলটি সকাল ৯টার দিকে টিএসসি থেকে শুরু হয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। ৪০-৫০ জনের মিছিলটি শহীদ মিনারের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশও করে। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে কোনো কর্মসূচি পালন করল ছাত্রদল।
সাংবাদিকতা বিভাগের মানববন্ধন
নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধন করেছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এই বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী ওই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য নন।
গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এই মৌন মানববন্ধনের পরে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র তারেক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীরা তাঁদের ন্যায্য দাবির কথা জানাতে গেলেই তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে মৌন মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে।
মানববন্ধনে বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক সংহতি জানিয়ে বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের বাম বহিরাগত সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে, যা সঠিক নয়। যারা আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছে, তারা সেসব চেনা মুখ, যারা বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছে।’