ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদে উপনির্বাচনের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নতুন ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ছয়টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনও তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ আদেশ দেন। নির্বাচনের জন্য ঘোষিত তফসিল স্থগিত চেয়ে দাখিল করা পৃথক দুটি রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ আদেশ দেন আদালত। অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেছেন আদালত। রুলে মেয়র পদে উপনির্বাচন ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), স্থানীয় সরকার সচিব, ইসি সচিব, ইসির যুগ্ম সচিব ও ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়রকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
স্থগিত হওয়ায় শুধু নির্বাচন ঝুলে যাওয়া নয়, গত বছর ২৬ জুলাইয়ের পর থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন গঠনের বৈধতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ৫-এর ৩ উপধারা অনুসারে ওয়ার্ডগুলোর দ্রুত নির্বাচন বাধ্যতামূলক। আইনের এ ধারায় বলা আছে, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯-এর ৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘মেয়রের পদসহ কর্পোরেশনের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে এবং নির্বাচিত কাউন্সিলরগণের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হইলে, কর্পোরেশন এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে যথাযথভাবে গঠিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।’ কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ১৮টি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় বৈধতার সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কারণ এ সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে নির্বাচিত কাউন্সিলর রয়েছেন ৩৬টিতে, যা মোট ওয়ার্ডের ৭৫ শতাংশের কম।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনী তফসিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যে রিট আবেদন করা হয় তাতেও এ সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়।
গত বছর ২৬ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করা ১৬টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে ৩৬টি ওয়ার্ড গঠন এবং এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনে মোট ওয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৯। এতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পুরনো ৩৬টির সঙ্গে নতুন করে ১৮টি ওয়ার্ড যোগ হওয়ায় ওয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪। আর দক্ষিণ সিটির ওয়ার্ডের সংখ্যা ৫৭টি থেকে ৭৫টিতে উন্নীত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ গত বছর ৮ আগস্ট এসব নতুন ওয়ার্ডের সাধারণ ও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের মোট ৪৮টি কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) অনুরোধ জানায়।
নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বিষয়টি সম্পর্কে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ার পর থেকেই এর গঠনের বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। শুধু নির্বাচন স্থগিত নয়, আগের ৩৬টি ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলরদের এবং সার্বিকভাবে এ সিটি করপোরেশনের বর্তমান কর্মকাণ্ড নিয়েও আইনি চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা রয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, ২০১৫ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ডিএনসিসি যথাযথভাবেই গঠিত হয়েছিল। তখন শতভাগ ওয়ার্ডেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে নতুন ১৮টি ওয়ার্ড গঠিত হওয়ার পর। সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এ ১৮টি ওয়ার্ডে নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়েছিল। নির্বাচন স্থগিত না হলে দ্রুত এ সংকটের সমাধানও হয়ে যেত। কিন্তু এখন অপেক্ষা করতে হবে এসংক্রান্ত মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত। জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে ডিএনসিসির বৈধতা রয়েছে কি না সে প্রশ্নের জবাব স্থানীয় সরকার বিভাগই বলতে পারবে। এর উত্তর আমাদের জানা নেই।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেকের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, আইন অনুসারে পূর্ণাঙ্গভাবেই ডিএনসিসি গঠিত হয়েছিল। এখন ৭৫ শতাংশের প্রশ্ন আর আসতে পারে না। এ নিয়ে জটিলতা হওয়ারও কথা নয়। নতুন ওয়ার্ড যুক্ত করার পর নির্বাচন কমিশনকে আমরা এসব ওয়ার্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। এখন এ নিয়ে মামলা হয়েছে। আদালত যেভাবে আদেশ দেন সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ওসমান গনি বলেন, ‘নতুন ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় ডিএনসিসি গঠন প্রশ্নে কোনো জটিলতা আছে কি না তার সঠিক কোনো উত্তর আমার জানা নেই। আমার জানা মতে, সরকারের সদিচ্ছা ছিল এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের।’
আমাদের আদালত প্রতিবেদক জানান, ডিএনসিসিতে নতুন অন্তর্ভুক্ত হওয়া এলাকার মধ্যে বেরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ও ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের পৃথকভাবে করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থাগিতের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বেরাইদের চেয়ারম্যান ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী ও মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন সেলিম। ভাটারার চেয়ারম্যান ও ভাটারা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান ও ব্যারিস্টার আহসান হাবিব ভুঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোখলেসুর রহমান। ইসির পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের জানান, আদেশের তথ্য ইসিকে জানানো হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গত ৩০ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক মারা যাওয়ায় মেয়র পদ শূন্য হয়। এ কারণে এ পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি গত ৯ জানুয়ারি। সে অনুযায়ী আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির মেয়র পদে উপনির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ওই দিন একই সঙ্গে ডিএনসিসিতে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি সাধারণ ও ছয়টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদেও নির্বাচন ঘোষণা করে ইসি। তফসিল অনুযায়ী আগামীকাল ১৮ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। এরই মধ্যে মেয়র পদে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম আর বিএনপি তাবিথ আউয়ালকে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দেয়।
রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহসান হাবিব ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ভাটারা ও বেরাইদ ইউনিয়নের এলাকাকে গত বছর জুলাইয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ এলাকার বাসিন্দাদের এখনো ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আগামী ৩১ জানুয়ারি ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে। কিন্তু ১৮ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন হওয়ায় নতুন যুক্ত হওয়া এলাকার ভোটাররা ভোট দিতে পারলেও কেউ প্রার্থী হতে পারছেন না। কারণ যিনি প্রার্থী হবেন তিনি এখনো জানেন না যে তিনি ভোটার কি না। এ ছাড়া শর্তানুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার কমপক্ষে ৩০০ ভোটারের স্বাক্ষর যুক্ত করতে হয়। ভোটার তালিকা প্রকাশ না হওয়ায় তাও দিতে পারছেন না এই এলাকার কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী।
গণসংযোগ চালিয়ে যাবেন আতিক
উচ্চ আদালত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করার পর ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম তাঁর সমর্থকদের হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেছেন, আপাতত নির্বাচন না হলেও তিনি গণসংযোগ চালিয়ে যাবেন।
আদালতের রায়ের পর ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম গত রাতে কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, দলের নির্দেশের বাইরে কোনো কিছুই করবেন না।
আতিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন নিয়ে অনেক রকম সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু কখনোই তিনি পিছপা হবেন না। আগামী দিনে যখনই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উপনির্বাচন হোক না কেন তিনি নৌকা প্রতীকের জন্য কাজ করে যাবেন।
নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে গণসংযোগ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তিনি।
ইসিকেই ব্যবস্থা করতে হবে : তাবিথ
ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, এখন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে। তাদের দ্রুত এটি সমাধান করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। গতকাল উচ্চ আদালত নির্বাচন স্থগিত করার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি এ কথা বলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘আমি এখন নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে। তারা কত দ্রুত এ বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় শেষ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমি আগের মতোই প্রস্তুত।’
তবে বিএনপির এই নির্বাহী কমিটির সদস্য বলেন, দ্রুত নির্বাচন না হলে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়বে। কারণ একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির জবাবদিহি থাকে তাঁর ভোটারদের কাছে। তাই যত দিন তারা তাদের পছন্দের প্রতিনিধি না পাবে, তত দিন কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।
‘জন-আশঙ্কার প্রতিফলন’
উপনির্বাচন স্থগিতের রায়কে জন-আশঙ্কার প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেছেন সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতারা। গতকাল আদালতের রায়ের পর পল্টনের মুক্তি ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এ প্রতিক্রিয়া জানান।
নির্বাচন স্থগিতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অশুভ আঁতাত আছে অভিযোগ করে নেতারা বলেন, নির্বাচনে বেশ কিছু আইনি ফাঁক-ফোকরের বিষয় নির্বাচন কমিশনকে আগেই জানানো হয়েছিল। সেগুলো সমাধান করে তফসিল ঘোষণার দাবি করা হলেও কমিশন বিষয়টি আমলেই নেয়নি।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আসলে জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো দলই জনতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। নির্বাচন স্থগিত চেয়ে রিট আবেদনকারীদের একজন আওয়ামী লীগ, আরেকজন বিএনপি ঘরানার লোক বলে শুনেছি।’
জোটের মেয়র প্রার্থী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘উচ্চ আদালত নির্বাচন স্থগিত করেছেন। এখন রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও অ্যাটর্নি জেনারেলের। তাঁরা এটি দ্রুত না করলে বুঝতে হবে এখানে সরকারের হাত আছে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সাইফুল হক, রুহিন হোসেন প্রিন্স, মোশরেফা মিশু, ফিরোজ আহমেদ, শুভাংশু চক্রবর্তী প্রমুখ।